Header Ads

মীর সাহেবের সরাই ❑ সেলিম ইসলাম খান ❑ ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব_২০

 


মী সাহেবেরা

সেলিম ইসলাম খান

উপন্যাস

ধারাবাহিক পর্ব_২০

ভোরে পাখির কিচির মিচির শব্দের সাথে প্রতিদিন জোয়ারগঞ্জ ঘাটও জেগে ওঠে। জেলেরা সাগর থেকে মাছ ধরে বড় বড় নৌকা এনে নোঙর করে। চারদিকে মাছ বিকিকিনির হৈচৈ শুরু হয়। সাগরে এখন ইলিশের মৌসুম চলছে। ইলিশের মৌসুমে হৈচৈ দশগুণ বেড়ে যায়। গঞ্জের ঘাট ক্রেতা এবং বিক্রেতার ভিড়ে মুখরিত হয়ে ওঠে। এছাড়াও আসেন মসজিদের ফজর নামাজের মুসল্লিরা। হাতে তসবিহ জপতে জপতে তারা বটগাছের শেকড়ে বসে মাছ বিকিকিনি দেখেন। মাছের পাশাপাশি তরিতরকারি ও ময়মশলার হাটও বসে। ইলিশের মৌসুমে বাজার বড় হয়ে বসে।

প্রতিদিনের মত আজও উত্তর চাটিগাঁর শাসক পরাগল খান তসবিহ হাতে মসল্লিদের সাথে বটতলায় বসেছেন। আর মাছের বাজার দেখছেন।

কিছুক্ষণ পর একটি বিশাল নৌকায় কয়েকজন রক্তাক্ত মানুষ এসে নামল। তারপর পরাগল খানের পায়ের কাছে এসে কান্নাকাটি জুড়ে দিল। তাদের সান্ত্বনা দিয়ে পরাগল খান বললেন, তোমাদের কি হয়েছে? তোমরা কি মগহার্মাদের কবলে পড়েছ?

আহতদের একজন বলল, জি হুজুর মগহার্মাদরা সাগরে আমাদের নৌকায় হামলা করেছে, গভীর রাতে আমাদের গ্রামে হামলা করেছে। আমাদের ঘরবাড়ি লুট করে বউ-বাচ্চাকে ধরে নিয়ে গেছে। তারা আমাদের গ্রামও আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। হুজুর আপনি এর বিচার করুন। আমাদের রক্ষা করুন।

পরাগল খান বললেন, আস্তাগফিরুল্লাহ, রক্ষাকারী একমাত্র আল্লাহ। আমি কেবল তার প্রতিনিধি। তা তোমাদের গ্রাম কোনটা?

লোকটি বলল, ইছাখালির দক্ষিনে বদইলা গ্রাম।

পরাগল খান তার উজিরকে আদেশ দিলেন, জেবল হক! এক্ষুনি যাও, ছুটি খানকে বল, বদইলা গ্রামে হার্মাদরা হামলা করেছে। সেনাদের নিয়ে এক্ষুনি বদইলা গ্রামে যেতে হবে।

জেবল হক জি হুজুর বলে খানবাড়ির দিকে দৌড় লাগাল।

পরাগল খান নৌকার মাঝিদের প্রস্তুতি নিতে আদেশ দিলেন, যেন সেনারা ঘাটে আসার সাথে সাথে নৌকা সাগরে ভাসাতে পারে। মাঝিদের সর্দার ভোলা কিছুক্ষণের মধ্যে সকল নৌকার মাঝিকে প্রস্তুত করে ফেলল।

ছুটি খান তার সেনাবাহিনী নিয়ে ঘোড়া থেকে নামলেন, তারপর পরাগল খান ও তার সাথীদের সালাম দিয়ে সামনে দাঁড়ালেন। সেনারা পিঠে তুণ ও হাতে ঢাল-তলোয়ার নিয়ে বেশ তাজিমের সাথে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াল।

পরাগল খান বললেন, দুলাল দাস কোথায়, তাকে দেখছি না কেন?

ছুটি খান বললেন, তার মেয়ে অসুস্থ। আমি তাকে ছুটি দিয়েছি বাবা। কিন্তু তার বল্লম বাহিনী আমাদের সাথেই আছে।

-ঠিক আছে। আমি তার চিকিতসার খবর নেব। তোমরা নৌকায় ওঠো। দ্রুত রওয়ানা হও। প্রতিটি মানুষকে হার্মাদদের হাত থেকে উদ্ধার করা চাই। তাদের বাড়িঘর আগের চেয়ে আরো সুন্দর করে বেঁধে দেয়া চাই। তাদের সুরাহা না করে, প্রতিটি মানুষকে উদ্ধার না করে জোয়ারগন্জ ঘাটে কেউই ফিরবে না। আমি ঘাট বন্ধ করে দেব।

ছুটি খানঃ জি বাবা। আপনার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হবে ইনশাআল্লাহ বলে সেনাদের নৌকায় ওঠার হুকুম দিলেন। তিনিও বিসমিল্লাহ বলে তার নৌকায় উঠে পড়লেন। নৌকার মাঝিরা হন্তদন্ত হয়ে দাঁড় বাইতে শুরু করল। চোখের নিমিষেই নৌকাগুলো সাগরের তীর ধরে ইছাখালি ফেরিয়ে দক্ষিণ দিকে বদইলা গ্রামের পথে ছুটে চলল।

পরাগল খান স্থানুবৎ বটের শিকড়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। সাথীরা বাড়ি যাওয়ার তাগাদা দিলেন। সব ঠিক হয়ে যাবে বলে স্বান্তনা দিতে লাগলেন। কিন্তু সে সব সান্ত্বনা বাক্য পরাগল খানের কর্ণকুহরে প্রবেশ করল না। তিনি নির্বাক হয়ে রইলেন। তার চোখ বিশাল বিস্তৃত নীল সাগরের ঢেউ পেরিয়ে পশ্চিমের দিকে নিবদ্ধ হয়ে রইল। সাগরের জলরাশির বিশাল ঢেউয়ের মত এই অশীতিপর বৃদ্ধের দুচোখ বেয়ে অশ্রুরাশিও অবিরল ধারায় ঝরতে লাগল। তার সাথীরাও সকলে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তাদের চোখেও নেমেছে অশ্রর বন্যা।

কিছুক্ষণ পর উজির জেবল হক এসে বলল, হুজুর আজ বাড়িতে খোলাজালি পিঠা রান্না হয়েছে। জামাইবাবাজি আপনি না যাওয়ায় খেতে বসছেন না। আপনার প্রিয় পান্তা ভাত আর আলুভর্তার সানকি নিয়ে বেগম সাহেবা বসে আছেন।আপনি না গেলে কেউ কিছু মুখে তুলবেন না।

এমন সময় জোয়ারগন্জ ঘাটে কয়েকটি লবণের নৌকা এল। আমীর পরাগল খান উন্মাদের মত ছুটে গেলেন তাদের কাছে। বললেন, তোমরা সীতাকুন্ড থেকে এসেছ না? পথে হার্মাদের নৌকা করে কাউকে ধরে নিয়ে যেতে দেখেছ?

লবণ মাঝিদের সর্দার এগিয়ে এসে বলল, না আমির সাহেব, আমরা সে রকম কোন নৌকা দেখিনি। তবে বদইলা গ্রাম থেকে আগুনের শিখা দেখেছি। মনে হচ্ছে সে খানে অগ্নিকান্ড ঘটেছে। তাই দেখে আমরা গ্রামে যাই, সেখানে শুনি হার্মাদরা গ্রাম লুট করেছে। মেয়েছেলেদের ধরে নিয়ে গেছে। যাওয়ার আগে গ্রামে আগুন দিয়েছে।

পরাগল খান কাকুতিমিনতি করে বললেন, তোমরা কি আমাকে একটু সে গ্রামে নিয়ে যাবে। আমার সব নৌকা আমার ছেলেরা নিয়ে গেছে। তোমরা দ্রুত লবণ খালাস করে আমাকে একটু নিয়ে যাও না ভাই।

মাঝিদের সর্দার বলল, নেয়া যাবে। কিন্তু আমার মাঝিরা দীর্ঘ পথ নৌকা বেয়ে সাগর পাড়ি দেয়ায় ক্লান্ত। তারা একটু বিশ্রাম চায়।

পরাগল খান বললেন, ঠিক আছে, আমাকে শুধু একটা নৌকা দাও। আমি নৌকা বেয়ে বদইলা গ্রামে যাব। তাদের সাথে বেদনা শামিল হব।

মাঝিদের সর্দার বলল, কিন্তু আপনি এই বয়সে এতদূর নৌকা বাইবেন কি করে! এটা সম্ভব নয় আমীর সাহেব। আর আমাকেও লবণ বিক্রি করতে হবে, নইলে আমিই নৌকা বাইতাম। তাছাড়া ঐ গ্রাম এখন কিছুই নেই। ভয়ে পলাতকরা ফিরে এসেছে শুধু, সারা গ্রাম আগুনে দাউ দাউ জ্বলছে।

নসরত শাহ বললেন, মাঝিভাই, আমার হৃদয়ও তেমনি জ্বলছে, সেখানে না গেলে এ জ্বলা প্রশমিত হবে না। খোদার নামে তোমাকে অনুরোধ করছি, আমাকে একটা নৌকা দাও ভাই।

মাঝিদের সর্দার বলল, ঠিক আছে, আমাকে একটু সময় দিন আমি কিছুক্ষণের মধ্যে লবণ খালাস করে নৌকা দিচ্ছি আপনাকে।

পরাগল খাঁর সাথীরা এতক্ষণ মাঝিদের সর্দারের কাছে তার অনুনয়-বিনয় দেখছিলেন। এখন তারাও পরাগল খানের সাথে বদইলা গ্রামে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করল। পরাগল খান বললেন, তোমরা কেন যাবে ভাই?

তারা বললেন, আমরা আপনার সব সময়ের সঙ্গী। এখন আপনি সেখানে যাওয়া উত্তম মনস্থ করেছেন। সুতরাং আমরাও আমাদের সঙ্গীকে একা ছাড়তে পারি না।

তাদের মুখে এই কথা শুনে পরাগল খান জেবল হকের হাত থেকে লাঠি নিয়ে বীর দর্পে আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে লাঠি আকাশে তুললেন। তারপর বঙ্গোপসাগরের দিকে বুক চিতিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন, তোমাদের সবাইকে যখন সঙ্গে পেয়েছি। আজ আমি শুধু বদইলা গ্রামের দুঃখের সাথীই হব না, আজ আমি হার্মাদদেরকেও উচিত জবাব দেব।

উপস্থিত সকলে তাজ্জব হয়ে পরাগল খানের রুদ্রমূর্তি দেখলেন। আর স্মৃতির দর্পণে ভাসলেন। এইত কয়বছর আগেও এই পরাগল খানই হার্মাদদের সাথে বীরদর্পে লড়াই করে তাদের সবাইকে রক্ষা করতেন। আজ আবার সেই দিন বুঝি ফিরে এল। সবাই স্মৃতি কাতর হয়ে আবেগে যার সামনে যা ছিল তাই হাতে তুলে নিয়ে আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে গঞ্জের হাট মুখরিত করে তুলল। কিছুক্ষণের মধ্যে বিশটি নৌকা করে সকলে সাগরের তীর ঘেঁষে দক্ষিণ দিকে ছুটল।

 

চলবে........

No comments

Powered by Blogger.