মীর সাহেবের সরাই ❑ সেলিম ইসলাম খান ❑ ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব_১৯
সেলিম ইসলাম খান
❑
উপন্যাস
পরদিন প্রত্যুষে
নসরতশাহ ও হৈতেন খান সুলতানী বাহিনী নিয়ে ছুটিখান, জাফর খান ও দুলাল দাসদের নিকট
থেকে বিদায় নিয়ে গৌড় অভিমুখে যাত্রা করলেন। ত্রিপুরা সেনাপতি রাইবরম ও গণিমতের
পাঁচশো ঘোড়া ও একশ হাতি সঙ্গে নিয়ে গেলেন।
রাইবরমকে গৌড়ে নিয়ে
হৈতেন খানের হেফাজতে রাখা হল। হৈতেন খানের সেনারা তাকে চোখে চোখে রাখেন। হৈতেন খান
তাকে ভাই বলে সম্বোধন করেন, যা রাইবরমের বেশ মজা লাগে। সে হৈতেন খানকে ক্ষেপাতে
চেষ্টা করে। কিন্তু হৈতেন খানের পেশী বহুল বাহু দেখে সে চুপসে যায়। খাবারের সময়
হৈতেন খান তাকে নিজের পাশে বসিয়ে খেতে বসেন। নিজের খাবারের পাত থেকে খাবার তুলে
খাওয়ান।
নামাজের সময় হৈতেন খান
মসজিদের বারান্দায় বসে বসে হাসে। সে অবাক হয়, এই লোকগুলো সারিবদ্ধ হয়ে দিনে
পাঁচবার কার উদ্দেশ্যে সিজদাহ দেয়? একজন সামনে থেকে আদেশ করে অন্যরা তার সাথে সাথে
উঠানামা করে। কি অদ্ভুত! এটা নাকি তাদের ইবাদত! আরে বাবা ভগবান এই খানিক উঠাবসায়
তুষ্ট হবেন? ভগবানকে তুষ্ট করতে হলে দুধ, কলা, হাঁস, পাঁঠা এইসব দিতে হয়!
রাইবরম সেনাদের
পালাক্রমে নামাজ আদায় দেখে আর তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে লুটোপুটি খায়। এই ভাবে এক
সপ্তাহ কেটে গেল, রাইবরমের হাসি ও তাচ্ছিল্য বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু মনে মনে সে এখনো
এরকম ইবাদতকে ঠিকই অবজ্ঞা করে। আরো এক সপ্তাহ কেটে গেল। রাইবরম এখন মসজিদের
বারান্দায় হৈতেন খানদের সাথে তাল মিলিয়ে নামাজ পড়তে চেষ্টা করে। এভাবে মাসাধিক কাল
কেটে গেলে একদিন রাইবরম সাহস করে মসজিদে ঢুকে সকলের সাথে নামাজ পড়তে
ঢুকল।মুয়াজ্জিন সাহেব তাকে মসজিদে ঢকতে দেখে ইমাম সাহেবের কাছে নিয়ে গেলেন।
ইমাম সাহেব বললেন,
রাইবরমবাবু। মসজিদে ইবাদতের আগে আমাদের সবাইকে পবিত্র হতে হয়।
রাইবরম বললেন, মাননীয়
ইমাম, আমি অন্যদের মত অজু করে এসেছি।
ইমাম সাহেব মৃদু হেসে
বললেন, আমি শুধু দেহের পবিত্রতার কথা বলিনি রাইবরমবাবু, ইবাদতের আগে যার ইবাদত করব
তার দেয়া নিয়ম পালন করতে হয়, তাকে পরিপূর্ণ বিশ্বাস করতে হয়, সেজন্য ছোট্ট একটা
আনুষ্ঠানিকতা আছে। আর তা হচ্ছে ঈমানের কালিমা পাঠ করা। কালিমা ছাড়া নামাজ হচ্ছে
ঘোড়া ছাড়া ঘোড়ার গাড়ি চালানোর সামিল।
রাইবরম বললেন, মহামান্য
ইমামসাহেব! আমি উপলব্ধি করেছি যে, এই সম্মিলিত শান্তিপূর্ণ ও সৌহার্দপূর্ণ ইবাদতই
সবচেয়ে সেরা। এখানে ধ্যান, জ্ঞান, কসরত, একাগ্রতা, শৃংখলা, সৌন্দর্য সবই রয়েছে।
শুরুতে এটাকে বেশ হাস্যকর মনে হলেও এখন আমি বুঝতে পেরেছি, একতা, শৃংখলা এই ইবাদতকে
সুন্দর ও তাৎপর্যপূর্ণ করেছে। আমি বিগত দিনগুলোতে এর অনিবার্যতা উপলব্ধি করেছি।
এখন আমি আনুষ্ঠানিকভাবে এক প্রভুর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এই মহান আদর্শের অনুগত
হয়ে নিজের জীবনকে অর্থবহ করতে চাই।
ইমাম সাহেব মাশাআল্লাহ
বলে সেনাপতি হৈতেন খানের দিকে তাকালেন। হৈতেন খান সম্মতির ইশারা দিলে ইমাম সাহেব
বললেন, ঠিক আছে, আপনি যখন ইমান আনতে আন্তরিক আগ্রহী, আমি আপনাকে কালিমা পাঠ করাব।
তার আগে আপনার একটা ভাল নাম পছন্দ করতে হবে।
রাইবরম বললেন, আমার এই
নসমটি কি ভাল নয় মহামান্য ইমাম সাহেব।
ইমাম সাহেব বললেন, বেশ
ভাল। তবে এটা মুসলমানদের নাম নয়। একটা ভাল নাম গ্রহণ করা দরকার।
রাইবরম বললেন, মহামান্য
ইমাম সাহেব আমার জন্য একটা ভাল নাম প্রদান করার অনুরোধ করছি।
ইমাম সাহেব বললেন, আমি
আমাদের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ফারুকের নাম প্রদান করছি। যার ন্যায়নিষ্ঠতা মুসলিম
জাহানে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।রাইবরম বলল, আলহামদুলিল্লাহ আমি সানন্দে
আপনার দেয়া নাম গ্রহণ করলাম।
এরপর ইমাম সাহেব
রাইবরমকে কালিমা তাইয়্যেবা পাঠ করিয়ে ইসলামে দীক্ষিত করিয়ে নিলেন। উপস্থিত সকলে
আলিঙ্গনের মাধ্যমে নওমুসলিম উমর ফারুককে দ্বীনিভাই হিসাবে গ্রহণ করে নিলেন।
এরপর উমর ফারুক অল্প
কয়েক দিনের মধ্যে ইমাম সাহেবসহ অভিজ্ঞদের কাছ থেকে দ্বীনের শিক্ষা গ্রহণ করে
নিলেন। তবে হৈতেন খান ইমান আখলাক শেখার ক্ষেত্রে তাকে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করলেন।
চলবে........
No comments