মীর সাহেবের সরাই ❑ সেলিম ইসলাম খান ❑ ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব_১৮
মীর সাহেবের সরাই
সেলিম ইসলাম খান
❑
উপন্যাস
পাখিডাকা ভোরে একশো
ত্রিপুরা সেনা চুপিসারে তাদের প্রার্থনা সেরে চতুর্দিকে হৈচৈ শুরু করল। অন্য
সেনারা ঘুম চোখে কি হয়েছে? কি হয়েছে? বলে চিৎকার চেচামেচি জুড়ে দিল। একশ সেনা বলল,
দক্ষিণ দিকে শত্রুসেনা। আমাদের অতি নিকটে। এটা শুনে ত্রিপুরার সেনাপতি রাইবরমের
নির্দেশে তীরন্দাজরা দক্ষিণ দিকে তীর নিক্ষেপ করতে লাগল। ততক্ষণে সে একশ সেনা পিছু
হটে গেল। এমন সময় দক্ষিণ থেকে তীরবৃষ্টি এসে ঘিরে ধরল ত্রিপুরা শিবিরে। কাটাগাছের
মত ঝুপ ঝুপ করে পড়তে লাগল তারা। অর্ধেক ত্রিপুরা সেনা চোখের নিমিষেই খতম হয়ে গেল।
বাকিরা সর্দারের হুকুমে ঘোড়া নিয়ে দক্ষিণের ময়দানের দিকে ছুটে চলল। তাদের হাতে
বল্লম ও তলোয়ার। উভয় পক্ষে মরণপণ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। যুদ্ধ ত্রিপুরা সেনারা
ঘুমচোখে অংশ নেয়ায় কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। তারা ছুটি খান, হৈতেন খান, জাফর খান,
দুলাল দাস, আলী আকবর ও দাউদ খানদের হাতে কচুকাটা হতে লাগল।
এক ঘন্টার মধ্যেই সমস্ত
ত্রিপুরা সেনা খতম হয়ে গেল। কিছুসেনা উদয়পুরের দিকে পালিয়ে গেল। ছুটি খান, হৈতেন
খান, জাফর খানরা তাদের ধাওয়া দিতে পিছু নিলেন। তারপর উদয়পুর পর্যন্ত ধাওয়া করলেন
তাদের। ত্রিপুরার সেনাপতি রাইবরমকে খুঁজে পাওয়া গেল না।
এদিকে যুদ্ধের ময়দানে
নসরতশাহ আহতদের সেবা ও শহীদদের জানাজা এবং দাফনের ব্যবস্থা করলেন। সুলতানী বাহিনীর
সাতাশজন শহিদ হলেন। আহত হলেন দেড়শত সেনা। ত্রিপুরার নয় শতাধিক সেনা নিহত, আহত কয়েক
হাজার। ত্রিপুরার আহত সেনাদেরও পরিচর্যার আদেশ দিলেন সুলতানজাদা নসরতশাহ।
বিকেলে বিলুনিয়ার
একগ্রাম থেকে হৈচৈ শুরু হল। গ্রামের এক লোক গেছেন বাড়ি থেকে দূরে জংলায় কাঁচা
পায়খানায়। তিনি পায়খানা সারছেন, কিছুক্ষণ পর মনে হল পায়খানার পাশের জংলায় বেশ
নড়াচড়া করছে কিছু একটা। তিনি ভাবলেন, বনমোরগ হবে হয়ত। তাই দ্রুত পায়খানা সেরে তিনি
জংলায় মোরগ ধরতে গেলেন। কিন্তু মোরগতো নয়, এ যে আস্ত মানুষ। তার গায়ে যুদ্ধের পোশাক
দেখে ভয়ে তিনি চিৎকার করে উঠলেন। তার চিৎকারে গ্রামের মানুষ সব জড়ো হয়ে গেল। পলাতক
সেনা ধরা পড়ল। গ্রামবাসী তাকে মেরে আধমরা করে দিল। এ খবর সুলতানী বাহিনীতে পৌঁছলে
জাফর খান এলেন ঘোড়া নিয়ে। তিনি দেখলেন, এ যে ত্রিপুরার পলাতক সেনাপতি। গ্রামবাসী
সুলতানী সেনাপতিকে পেয়ে বেশ খুশি হলেন। তারা রাইবরমকে তার হাতে তুলে দিলেন। জাফর
খান রাইবরমকে নিয়ে নসরতশাহের কাছে ফিরে এলেন।
রাইবরমসহ যুদ্ধবন্দী
সকল ত্রিপুরা সেনাকে খন্ডলের বৃদ্ধ শাসক হাফিজউদ্দিনের কাচারিতে নিয়ে এলেন। তিনিই
তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করবেন।মাগরিব নামাজান্তে হাফিজউদ্দিনের কাচারিতে রাইবরমসহ
বন্দী সকল ত্রিপুরা সেনাকে হাজির করা হল। হাফিজউদ্দিন তাদেরকে খন্ডল আক্রমণ করার
জন্য তিরস্কার করলেন। তারপর আত্মপক্ষ সমর্থন করে কথা বলার সুযোগ দিলেন। তারা
লজ্জিত হয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করল। হাফিজউদ্দিন বললেন, ক্ষমা করে ছেড়ে দিলে তোমরা আবারও
আসতে পার, তোমরা মেহেরকুল, গঙ্গামন্ডল, কৈলাশশহরে বহুবার হামলা চালিয়েছ, খন্ডলে
হামলা করার মত স্পর্ধাও এবার দেখালে। কি করে বুঝব তোমরা আবার হামলা চালাতে আসবে
না।
রাইবরম বলল, আমরা আর
হামলা করব না মহামান্য। আমরা ভগবানের নামে শপথ করছি, আমরা আর খন্ডল লুট করতে আসব
না।
হাফিজউদ্দিন বললেন,
তোমরা সব জায়গায় লুণ্ঠন করেছ, প্রাণ হরণ করেছ। খন্ডল দখল করতে সশস্ত্র হয়ে এখানে
এসেছ, আমরা তোমাদের এমনি এমনি ছেড়ে দিতে পারি না। যদি তোমাদের পালের গোদা
ধন্যমানিক্য মুছলেকা দিয়ে তোমাদের ছাড়িয়ে নিতে আসে তবে তোমাদের মুক্তির কথা আমরা ভেবে
দেখব। তাও তখনি সম্ভব হবে যদি আমাদের সুলতান আলাউদ্দিন হোসেনশাহ এতে সম্মত হন। আমি
বাদীপক্ষ সুলতানজাদাকে কিছু বলার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।
সুলতানজাদা নসরতশাহ
বললেন, আমি আপনার ফয়সালা সানন্দে গ্রহণ করছি। আমি আরজি জানাচ্ছি, তাদের একজন বন্দী
সেনাকে বিচারের ফয়সালা লিখিতভাবে জানিয়ে ত্রিপুরারাজ ধন্যমানিক্যের কাছে পাঠানো
হোক। যতদিন তার শপথনামা গৌড়ের সুলতানের দরবারে না পৌঁছবে ততদিন রাইবরম গৌড়ে বন্দী
হয়ে থাকবেন। বাকি বন্দীদের নিয়ে আপনি ফয়সালা দেবেন।
হাফিজউদ্দীন সাহেব
বললেন, ঠিক আছে মহামান্য ছোট সুলতান। আমি মনে করি সেনারা পেটের দায়ে যদ্ধ করতে
এসেছে। আমি এসব বন্দীদের আমার এখানে কাজ দিয়ে তাদের জীবিকার ব্যবস্থা করে দিলে
তারা এমন লুটতরাজের কাজ ছেড়ে দিবে।
নসরতশাহ বললেন, এটা
আপনার মহানুভবতা। এ কাজ করতে পারলে বেশ উত্তম হবে। আশাকরি তারা অন্ধকার পথ ছেড়ে
আলোর পথে ফিরে আসবে।
রাইবরম বললেন, মহামান্য
সুলতানজাদা যদি সুযোগ দেন, আমিও লুটতরাজ ছেড়ে আলোর পথে পাড়ি দিতে চাই।
নসরতশাহ বললেন, তাহলে
গৌড়ে আমিই তোমার জিম্মাদার হব।
চলবে........
No comments