অবন্তিকা ❑ উপন্যাস ❑ কিশোর পণ্ডিত ❑ পর্ব ০৯
উপন্যাস
অবন্তিকা
কিশোর
পণ্ডিত
অবন্তি অনেক ভেবেছে সুকমলকে নিয়ে । অনেক কেঁদেছে তার ভালবাসা নিয়ে ।। কাঁদতে কাঁদতে যেন তার চোখের জল শুকিয়ে গেছে । আর ভাবতে চায় না । আর কাঁদতে চায় না সে । সকল ভাবনা ভুলে সহজ হতে চায় অবন্তি । সেদিন দেবাশীষের মুখ থেকে তাদের পরিচয় জেনে একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল অবন্তি। ভালবাসার সুকমল কিভাবে তাকে ঠকাল । হায়রে সুকমল । বহুরুপি তুমি বহুরুপ তােমার ভালবাসার । সেদিন থেকেই দেবাশীষ পিছু লেগেছিল সুকমলদের । তাদের সকল খবর কখন কি ঘটছে, কখন কৃষ্ণা সুকমল কি করছে, সব খবর সংগ্রহ করে দেবাশীষ অবন্তিকে জানাত । আজ সুকমলের কি অবস্থা সবই জানে অবন্তি ।
দুপুর বেলা কে যেন কলিংবেল বাজাল অবন্তিদের বাসায় । দেবাশীষ দরজা খুলতে গিয়েই দেখে সুকমল । দেবাশীষ বুঝতে পারছিল না যে তাকে আসতে বলবে না যেতে বলবে । সুকমল বাসায় ঢুকে পড়ল । বলল , মাসীমা আছেন না । দেবাশীষ বলল , দেখতে হবে আপনি একটু অপেক্ষা করুন । দেবাশীষ ভিতরে গিয়ে বলল , মাসীমা সুকমল চৌধুরী এসেছেন তাকে বসতে বলব না যেতে বলব । কেয়া চৌধুরী কিছুক্ষণ ভাবলেন তারপর ভেবে বললেন , বসতে বল । সুকমল বসল । কেয়া চৌধুরী সামনে আসতেই সুকমলকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন । আজকের সুকমল আর আগের মত নেই । কি অবস্থা হয়েছে ওর । গায়ের সে রং নেই । আগের চেহারা নেই । মাথার চুল ঝরে টাক পরেছে । একি চেহারা হয়েছে সুকমলের । ভাবতে ভাবতে কেয়া চৌধুরী তার সামনে গেলেন এবং বসলেন । বললেন কেমন আছাে সুকমল । সুকমল কিছু বলতে পারল না । সে কেঁদে ফেলল । কেঁদে কেঁদে সব বলল । তার একটা কাজের জন্য তার বাবা কেমন করে মারা গেছে । তার মা তাকে কেমন করে ত্যাগ করেছে । মিসেস চৌধুরী সকল শুনে দুঃখিত হলেন । সুকমল বলল আমি যে অন্যায় করেছি তার জন্য শুধু ক্ষমা চাইতে আজ এসেছি । সুকমলের কথা শুনে অবন্তি তার ঘরের দরজা বন্ধ করে বসেছিল । সুকমল অবন্তির সাথে দেখা করে ক্ষমা চাইতে চাইল । কিন্তু বহু অনুরােধের পরেও অবন্তি দরজা খুলল না । শেষে সুকমল বাইরে থেকেই বার বার ক্ষমা চাইল । বলল যদি পার এই পাপীকে ক্ষমা করার চেষ্টা করাে । আমার পাপের ফল বিধাতা আমায় দিয়েই চলেছেন । হয়ত পাপ এখনাে শেষ হয়নি । আরো শাস্তি দিবেন । বলেই সে ও বাড়ী থেকে চলে গেল । সুকমল চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর অবন্তি ঘর থেকে বেরিয়ে আসে । দেবাশীষ তাকে দেখে এগিয়ে যায় । অবন্তি কোন কথা বলছে না । সে শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে । দেবাশীষ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে কেঁদো না দিদি । মানুষ শুধু তার কর্ম করে যায় । ভাগ্য লেখেন বিধাতা । যার ভাগ্যে যা লিখেছেন তাই হবে । মানুষ শুধু তার কর্মের দ্বারা ভাগ্য কিছুটা বদলিয়ে নেয় । যেমন নিয়েছে সুকমল বাবু । তার কর্মই তার আজকের পরিস্থিতির জন্য দায়ী । ভগবান জানতেন যে তােমার সাথে সুকমলের বিয়ে হলে ভাল হতাে না । তাই ভগবান তা করেন নি । তােমার ভাগ্যে ভগবান ভালই লিখেছে ।
দেবাশীষের কথাগুলাে অবন্তি শুধু শুনে যায় কিছু বলে না সে । তার শুধু পূর্বের স্মৃতি গুলাে মনে পড়ে । কত ভালই না বেসেছিল সে । কত সুখের আশাই না করেছিলে সে । তার সুখ কোথায় তার আশাগুলাে কোথায় । এই তার ভালবাসার পরিণতি । কেমন ভালবেসেছিল সে । তার ভালবাসার জোর নেই কেন । তিরস্কার করে নিজেকে । আবার ভাবে বিধাতার খেলা বােঝা বড় দায় । তার খেলা তিনি খেলে চলেছেন । আমরা তাে পুতুল মাত্র । শুধু হাসব আর কাঁদব । স্নেহের ভালবাসা , শ্রদ্ধার ভালবাসা দুটি মনের দেয়া নেয়ার ভালবাসা সবই ভালবাসার জন্য হয় । আসলে সবই ভালবাসার জন্য ভালবাসা । তাহলে তার ভালাবাসায় খাদ কোথায় । সে তাে ভালবেসেছিল সুকমলকে । তাহলে ভালবাসার জন্য ভালবাসা না হয়ে আঘাত কেন পেল । ভাবে অবন্তি । আসলে মানুষের মনের কথা ভাবা যায় না বুঝাও যায় না । এ যেন শরতের আকাশ । এখন এমন তখন তেমন । তাহলে ভাগ্যই অবন্তিকে নিয়ে যাচ্ছে তার গন্তব্যে । তার চলার শেষ কোথায় । কত দূরে তার গন্তব্যস্থল । ভেবে পায় না সে । অবন্তি দেবাশীষকে বলে তুমি ভাগ্য গণনা করতে পার । যদি পার তবে বল কি আছে আমার ভাগ্যে । আর কত কষ্ট আর কত দুঃখ এ কপালে লেখা আছে । দেবাশীষ অবন্তির মুখপানে চেয়ে থাকে আর ভাবে মানুষের ভাগ্য লেখা আর বলা মানুষের সাধ্যে কি আছে । অবন্তির মুখ পানে চাইতে পারেনা দেবাশীষ তাই দুরে গিয়ে নীরবে চোখের জল ফেলে । যার করার আর কিছু নাই তার চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কিই বা করার আছে । দেবাশীষ ভগবানের কাছে কর জোড়ে হাত তুলে বলে এ দুঃখের শেষ দাও প্রভু ।
যেখানে অনেক যন্ত্রনা সেখানে অনেক বঞ্চনা ,
সেখানে সুখ কাঁদে ।
যেখানে অনেক আনন্দ যেখানে অনেক সুখ ।
সেখানে দুঃখ কাঁদে ।
ভালবাসায় ভালবাসা কাঁদে আবার হাসে ।
হৃদয়ে সে আছে অন্তরে সে অছে
সবখানে । সেখানে মনের অন্তগহীনে
তবে কেন ভালবাসা পালায় ?
হারিয়ে যায় কোন পথে ?
এ পথে পাহারা দেই আমি ।
ও পথে আমার অসীম ভালবাসা ।
সব পথে পাহারা ।ভালোবাসার পাহারা
তবুও ভালোবাসা পালিয়ে যায় ।
হারিয়ে যায় ছলনা দিয়ে ।
একটি কবিতা লেখার চেষ্টা করছিল পার্থ ।আংশিক লিখে লেখা শেষ করে । মাঝে অবন্তির কথা মনে পড়ে । কেমন আছে অবন্তি হয়তাে রানীর সুখে । সুকমল কেমন জেতাটা না জিতল । অবন্তির মন জয় করেছে । সে অবন্তির ভালবাসা পেয়েছে । রাজার ভাগ্য সুকমলের । রাজ - রানীর ভালবাসা পেয়েছে । রাজপুত্র আর রাজকুমারীর ভালবাসা । এ যে রাজ - রানীর ভালবাসা । ঐ ভালবাসায় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সে ।তার সাহস কত বড় । সামান্য এক ভিখারী ভালবাসতে চায় রাজকুমারীকে । না এ উচিত নয় । উচিত ছিল না । আসলে মনের কোন আক্কেল নেই । প্রাণের আসলে স্পর্ধা সীমাহীন ।হৃদয়ের নেই কোন ভয় ডর । বেরসিক মানুষের মন । যে কোন কাজই করিতে চায় । হােক সে রাজা হােক সে ভিখারী । এমন ভিখারী পার্থকে অমন রানী অবন্তি অবজ্ঞা তাে করবেই । এটাই আসল সত্য । এটাই রূঢ় বাস্তবতা । পার্থ প্রতীম রায় এখন গ্রামের মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ায় অন্যের জমিতে কলের লাঙ্গল চড়িয়ে চাষ করে জমি । সােনালি ফসল ফলায় । স্বনির্ভর হতে চেষ্টা করছে সে । সারাদিন কঠিন পরিশ্রম করে অবসরে যে টুকু সময় পায় সেটুকু আবার ব্যয় করে লেখার কাজে । একটি দুটি বইও বাজারে বেরিয়েছে ওর । ভালই লেখে । ওর লেখা মানুষে পড়ে । প্রথমে কবিতা লিখত পার্থ । পরে গল্প । এখন ছােট খাটো উপন্যাস লেখার চেষ্টা করছে । যদি এতে ভাগ্য বদলে যায় সেই আশায় আছে ও । মা ছেলেকে কিছুই বলে না । যা ইচ্ছে ওর তাই করে সে । তার মা আরও তার কাজে উৎসাহ জোগায় । পার্থ মায়ের প্রেরণায় কিছু কিছু এগিয়ে যাচ্ছে । কিন্তু কঠিন পরিশ্রমে ভেঙ্গে যায় ওর শরীর ।
পার্থর এগিয়ে যাওয়ার আশা ছিল ঠিকই । কিন্তু প্রাণের কোন মায়া ছিল না । আসলে যে প্রাণ সপে দেওয়া হয় সে প্রাণ আর প্রাণে থাকে না । তার প্রাণ যা চেয়েছিল সে ছিল তাই । আর তাই যদি ফসকে যায় প্রাণ থাকে কোথায় । ভালাবাসা ফুরিয়ে যায় হারিয়ে যায় অন্তর থেকে । পার্থর কেবল মনে হয় তার অন্তরে বুঝি আর কোন ভালবাসা নেই । আর বুঝি মায়া নেই । আর বুঝি দুঃখ কষ্ট নেই । প্রাণই যদি না থাকে প্রাণে জীবন তখন অসার হয়ে যায় । তাই অসার জীবনে কোন সার খুঁজে পায় না পার্থ । শুধু বাঁচার জন্য এগিয়ে যায় । মনে পড়ে সেই বিভীষিকাময় দিনের কথা । যখন অবন্তি সুকমলকে পরিচয় করে দিয়ে বলেছিল সে তার সব । অন্য কেও নয় । মনে পড়ে পার্থের তখন সে যেন মরে বেঁচেছিল । পা তার মাটিতে পরে নাই । নিঃশ্বাস যেন বাতাসে বহে নাই । চক্ষু যেন পৃথিবী দেখে নাই । প্রাণ যেন দেহে নাই । কিভাবে সে ঐ স্থান ত্যাগ করেছিল । তার মনে আছে । সবই ভালবাসার এক কষ্টময় ক্রান্তি কাল । কিছু বুঝে না । শুধু প্রাণ প্রাণের জ্বালা বাড়ায় । আশা বাড়ায় ভ্রান্তি । বেঁচে আছি না মরে গেছি কিছু বুঝা যায় না । আসলে ওরকম ভালবাসায় দেহ থাকে ঠিকই কিন্তু প্রান থাকে না । দেহ ও আত্মা গড়ে আলাদা বসতি । তখন আত্মার কোন জোর থাকে না । প্রাণের কোন স্পন্দন থাকে না । মনে থাকে না আত্মতৃপ্তি । শুধু দেহের জোরে জড় দেহ বেঁচে থাকে । ও দেহ হেসে যায় কেঁদে যায় খেলে যায় ।
চলবে.....


.jpg)


.jpg)
.jpg)
No comments