আমাদের শৈশব ও ফেলে আসা স্মৃতি
আমাদের
শৈশব
ও
ফেলে
আসা
স্মৃতি
শাহীন
আকবর
❑
পিছনে
ফিরে দেখা খুব কঠিন। ঘুমিয়ে পড়া স্মৃতিরা সব একসাথে জেগে ওঠে না। সময়ের ধুলাের নিচে
চাপা পড়ে যাওয়া দিনগুলাে চোখের সামনে সজীব না হয়ে উঠলেও মাঝে মাঝে কিছু কিছু দৃশ্য
চোখের সামনে ঝলসে ওঠে। মনে হয়, আহা! আবার যদি সেই ছােট বেলায় ফিরে যেতে পারতাম! পেছনে
হাঁটতে হাঁটতে যদি পেয়ে যেতাম ছােটবেলার খেলার সাথীদের, যদি পেয়ে যেতাম সেই সবুজ
মাঠ! মেঠো পথ ধরে বুনাে ফুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে যদি পৌঁছে যেতাম সেই খােলা মাঠে, যদি ফিরে
পেতাম ছােটবেলার সেই নরম বিকেলবেলাটি!
❑
তাহলে
আবার সেই দাড়িয়াবান্দা, গােল্লাছুট, বরফ পানি খেলতাম। দৌড়ে একজন অন্য জনকে ছুঁয়ে
বরফ করে জমিয়ে দিতাম বা পানি বলে ছাড়িয়ে নিতাম জমাট বাধা থেকে। আহা! কি নির্মল দিনই
না আমরা কাটিয়েছি সেই বেলায়! যদি নিশ্চিন্তমনে
সব কিছু ভুলে খেলায় ডুবে যেতে পারতাম আবার! ফুলটোকা খেলতে গিয়ে যদি হতাম ফুলদলের
রাজা! তাহলে নিজের মনের মতাে করে একেকজনকে একেক নাম দিয়ে ডাকতাম "আয় রে আমার
বেলী", "আয়রে আমার গােলাপ”!
কিং কং খেলতে গিয়ে বন্ধুদের গায়ে জোড়ে বল ছুড়ে তাদের ব্যথা দিয়ে অবুঝ আনন্দে মেতে
উঠতে পারতাম আবার!
❑
ইচ্ছে
হয় বর্তমানের সাথে, শিশুবেলার সাথিদের সাথে আড়ি নেবার মতাে করে আড়ি নিই। আড়ি নিয়ে
চলে যাই সেই শৈশবে। ফিরে যাই রূপকথার মতাে সেই শিশু কালে। যেখানে রাক্ষস বা ডাইনি বলতে
থাকবে পাড়ার নির্দয় কোন বয়স্ক লােক, সে আমাদের দিকে লাঠি নিয়ে তেড়ে আসবে গাছে ঢিল
ছোঁড়ার কারণে, যেখানে মা ভাত মেখে নিজ হাতে খাইয়ে দেবে, পেট ভরে গেলেও জোড় করে লােকমা
বানিয়ে মুখে তুলে দিবে।
আফসােস
হয়, মায়ের কাছে রূপকথার গল্প শুনতে শুনতে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়া আর হবে না। হবে
না ভূতের ভয়ে কাঁথার নিচে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকা, খেলার মাঠে নিঃশব্দ পায়ে ফড়িং
ধরা, স্কুলের বাগান থেকে চুপিচুপি ফুল ছেঁড়া। প্রজাপতি দেখে প্রজাপতির হয়ে উড়ে বেড়ানাের
ইচ্ছা যে শিশুকালেই শেষ হয়ে যায়। এসব যেন অন্যরকম অনুভূতির ব্যাপার। বাবার হাত ধরে
মেলায় গিয়ে খেলনা কেনার দিন চলে গেছে যে সেই কবে, কোন শৈশবে! ভাবতেই মনটা ভীষন খারাপ
হয়ে যায়। আচ্ছা, আমাদের সময়ের মতাে এখনকার শিশুরাও কি কাঁচের বােতল বা ছেঁড়া স্যান্ডেল
জমিয়ে হাওয়াই মিঠাই বা কটকটি কিনে খায়? আইসক্রীমের বাক্স নিয়ে বিক্রেতারা এখনাে
কি 'আইসক্রীম', বা 'মালাই', বলে হাক ছাড়ে? মনে হয় না ছাড়ে।' বা 'লেইস ফিতা, লেইস!'
বলে বিক্রেতারা ঘরের শিশুদের বা মায়েদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে পাড়া মহল্লায় ফেরি করে
বেড়ায়?
❑
লিচুর
সময় ফল খেয়ে তার বিচিগুলাে কৌটোয় জমিয়ে রাখতাম খেলার জন্য। বােনদের সাথে পাথর দিয়ে
পাঁচগুটি, কড়ি খেলা, কুতকুত খেলা, পুতুলখেলা বা হাড়িপাতিল খেলা খেলেছি অনেক। শৈশব
ছিল বলেই হয়তাে মেয়েদের খেলা বা ছেলেদের খেলার পার্থক্য বুঝিনি তখন। বড়রাও কিছুই
বলেনি বা বাঁধা দেয়নি। তাই আনন্দের সাথেই খেলেছি। বন্ধুদের সাথে ছড়া কেটে কেটে যে
আনন্দ পেতাম তার তুলনা অন্য কোন কিছুতেই পাইনি।
❑
একজন
যদি বলতাে, 'ওপেনটি বায়স্কোপ! নাইন টেন টেইস্কোপ!' তাহলে অন্যজন সাথে সাথে শুরু করে
দিত, 'চড়ুই পাখি ১২ টা, ডিম পেড়েছে ১৩ টা! ১ টা ডিম নষ্ট, চড়ুই পাখির কষ্ট!' বা
'উবু দশ নাড়ি ভুড়ি চিংড়ি মাছের চচ্চরি! কে কতাে আনা নেবে বলে দাও না গাে ভাই' বা
'রেডি ওয়ান টু থ্রি, পাইলাম একটা বিড়ি! বিড়িতে নাই আগুন, পাইলাম একটা বেগুন......!'
স্কুল ছুটির ঘন্টা বাজলে বই কাঁধে নিয়ে ছড়া বলতে বলতে দৌড়ে দিয়ে ক্লাস থেকে বের
হয়ে যেতাম, 'ছুটি! গরম গরম রুটি, এক কাপ চা! সবাই মিলে খা!'
❑
স্মৃতির
জলে সাঁতার কাটতে গিয়ে কেমন যেন একটা আফসােস চলে আসে, বারবার মনে হয়, ইশ যদি ফিরে
পেতাম সেই শৈশব! যদি চিরটাকাল শিশু হয়েই কাটাতে পারতাম! সেই সময়টায় সব কিছুতেই ছিল
বিস্ময়।
আকাশ
দিয়ে উড়ােজাহাজ ভোঁ করে উড়ে যাবার সময় সেই শব্দ শুনে বিস্ময়ে সব শিশুরা বাড়ির
উঠানে চলে আসতাম। নিচে দাঁড়িয়ে থেকে টাটা দিতাম, আমাদেরকে পাখায় তুলে নিয়ে যাবার
আহ্বান করতাম! মনে মনে ভাবতাম, এটা তাে পাখি না, তাও উড়তে পারে!
❑
একটু
বড় হতে থাকলে খেলার ধরণ পালটে গেছে, কাবাডি খেলতে গিয়ে কতবার যে হাত পা ছুলে গেছে
তার হিসেব নেই, বৃষ্টিতে ফুটবল খেলতে গিয়ে কতবার মাঠে পিছলে পড়েছি, কতােবার হাত পা
ব্যথা নিয়ে বাড়িতে এসে মায়ের কাছে কিল খেয়েছি, হিসেব নেই।
লাটিম
কেনার জন্য বা ঘুড়ি জন্য সুতােয় রঙ দেবার টাকা পাব কোথায়? তাই মায়ের আঁচলের গিট
খুলে পয়সা নিয়েছি বা বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি করে মার খেয়েছি বহুবার। বৃষ্টির
দিনে দল বেধে বৃষ্টিতে ভিজে গায়ে জ্বর বাঁধিয়েছি কতােবার! ঝড়ের বাতাসে গাছ তলায়
আম কুড়ানাে দিনগুলি এখন ফেলে আসা শৈশব থেকে কুড়িয়ে আনি। এনে কিছু পাই না, পাই শুধু
হারিয়ে ফেলার দীর্ঘশ্বাস। মনে পড়ে, টিনের চালার সেই বৃষ্টি পরার মধুর ছন্দ, ঝড়ের
সময় ভাই বােনদের নিয়ে আম্মার খাটের তলায় আশ্রয় নেবার কথা। সব কিছুই যেন স্বপ্ন
এখন!
❑
স্বপ্নের
মতাে সেই দিনগুলাে আরও স্বপ্নময় হয়ে যেত যখন শুনতাম শীতে স্কুল বন্ধের সময় নানাবাড়ি
বা দাদাবাড়ি বেড়াতে যাব। ওসব জায়গায় বেড়ানাে ছিল যেন কোন বেহেস্তখানার মতাে, যেন
কোন পরীস্থানে ঘুরতে যাওয়া। মায়ের শাসন নেই, বাবার ধমক নেই, নেই সন্ধ্যেবেলায় বই
নিয়ে বসার ঝামেলা। বেড়ানাের ওই সাত-আটটা দিনের জন্য আমরা ভাই বােনেরা যেন অপেক্ষায়
থাকতাম সারা বছর! নানা-নানু আর নেই, তাই বাড়িটাও স্থান বদল করে চলে গেছে স্মৃতির জগতে।
❑
মাঝে
মাঝেই ভাবি এসব স্মৃতিচারণ করে কি লাভ? সেই দিনগুলো তাে আর ফিরে পাব না! কিন্তু গাছের
পাতা গলিয়ে বের হয়ে আসা এক চিলতে মায়াবী রােদ যেমন অন্যরকম ভাললাগা তৈরী করে, তেমনিভাবে
স্মৃতিরা সময়ের গন্ডি ছাড়িয়ে মনের দরজায় উঁকি দিলেও ভালাে লাগায় মনটা ভরে ওঠে।
সে দিনগুলাে ফিরে না পাওয়ার বাস্তবতা এবং ফিরে পাবার গভীর আকুতিভরা এই যে মিশ্র অনুভূতি,
সেটাই তাে আমাদের এই বেঁচে থাকার রশদ! ছােটবেলা ছােটবেলার সাথে সাথে হারিয়ে যায়।
আর বড়বেলা হারিয়ে যায় হারানাে ছােটবেলা খুঁজতে খুঁজতে। জীবন সেজন্যই তাে এতাে এতাে
মধুময়, এতাে সুন্দর, এতো ক্ষনস্থায়ী লাগে!
❑
বৃহস্পতিবার,
২০ ই মে' ২০২১
ভাদেশ্বর,
গোলাপগন্জ, সিলেট।
No comments