বকর স্যারের খাওয়ার আক্ষেপ
বকর স্যারের খাওয়ার আক্ষেপ
শাহ্ ইদ্রিস
❑
কলি মাহমুদ হাই স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক বকর স্যার। আমার বন্ধুর বাবা ঐ স্কুলের হেডটিচার । আমিও ঐ স্কুলে দিন কয়েক পড়েছি। সেই হিসেবে আমি হেড স্যারের ছাত্র। আমি স্যারকে স্যার না বলে খালুজান বলি । কারণ স্যারের ছেলে আমার সবচেয়ে ক্লোজ ফ্রেন্ড । আর যে কয়দিন পড়েছি তাতে স্যারের মনেও নেই আমি তাঁর ছাত্র। স্যারও ইংরেজি পড়াতেন। যে কয়দিন ক্লাস করেছি তাতে স্যার আমার হাতের লেখার বেশ প্রশংসা করেছেন। এটা এখনো আমার মনে আছে। হাতের সুন্দর লেখা একটা আর্ট। ভালো ছাত্র হলেই সুন্দর লেখা হবে তা কিন্তু নয়, আবার মন্দ ছাত্রের লেখা যে সুন্দর হয় সেটাও কিন্তু অসত্য নয়। তো যাইহোক বকর স্যার বছর খানিক হলে এই স্কুলে জয়েন করেছেন। সে একজন ভালো শিক্ষক সেটা সবাই আন্দাজ করতে পারলেও , সে যে একজন খাদক ব্যক্তি তা কেউ জানতেন না। মজার ব্যাপার হলো স্যার সদ্য শাদি করেছেন। নতুন নতুন শ্বশুর বাড়ি । জামাই আদর থাকে অন্য রকম। জামাইকে খাওয়ানো হয় বড়ো বড়ো মোরগ, খাসির গোস্ত ও গরুর গোস্ত। সকাল বেলা থাকে দেশি মুরগির ডিমসিদ্ধ। শুধু আমাদের এলাকায় নয়, সারা দেশে জামাইকে বেশি আদর যতœ করে শ্বশুর-শ্বাশুরি। জামাই আসবে বলে বকর স্যারে শ্ব¦শুর ৫কেজি গরুর গোস্ত নিয়ে এসেছে বাজার থেকে। রাত্রিবেলা মুরগির গোস্ত দিয়ে খাবার সেরেেেছ। পরের দিন সকালবেলা জামাইকে গরম ভাত আর গরু গোস্তের ভুনা দিয়ে খাবার দিয়েছে শ্বাশুরি মা। একমাত্র জামাই আদর তো তার একটু বেশি থাকবেই, স্বাশুরি মা জামাইয়ের পাতে গোস্ত তুলে দিচ্ছে জামাই বাবা শুধু খাচ্ছে আর খাচ্ছে। খেতে খেতে পাতিলের সব গোস্ত এবার শূন্যের কোঠায়। শ্বাশুরি মা জামাইকে জিজ্ঞেসা করলে আরও গোস্ত লাগবে কি না? বকর স্যার চোখ দুটো দিয়ে দুষ্টু হাসি হেসে বলেন, আর একটু হলে ভালো হতো আম্মা। স্যারের শ্বাশুরির এবার মাথায় হাত গোস্ত কোত্থেকে দেবে। আঁচলে মুখটা ঢেকে লজ্জা আর শরমে চলে গেলেন অন্য রুমে। বকর স্যার বুঝতে পারলেন গোস্ত এবার শেষ। বকর স্যার খাওয়া দাওয়ায় তেমন একটা শরমবোধ করেন না। শরম করলে তো খাবার খেতে পারবেন না।
স্যারের শ্বশুর মশাই বাড়ির বাইরের কাজ সেরে বাড়িতে এসে ভাত খেতে বসলে শ্বাশুরি তাকে মরিচ ভর্তা পাতে দিয়ে খেতে দিলেন। শ্বশুর মশাই রেগে গেলেন, ‘তুমি কি আমার সাঙ্গে ইয়াকি করছো? গত কালইতো বাজার থেকে পাঁচ কেজি গরুর গোস্ত আনলাম আর আমাকে দিচ্ছো মরিচ ভর্তা দিয়ে ভাত। গোস্তের তরকারী গেলো কই?’ ‘আস্তে কথা বলো, ঘরে জামাই বসা। এই বয়েসে তোমার সঙ্গে ইয়ারকি-টিয়ারকি কিছুই করছি না বাপু। মন দিয়ে শোনো, সকালবেলা তোমার জামাইকে ঐ গোস্তের তরকারী দিয়ে ভাত দিয়াছিলাম আর তোমার জামাই একে একে সব তরকারী উদরপুরো করেছে। সে আরও আবদার করেছিলো কিন্তু আমি লজ্জা আর শরমে কিছু কইতে পারিনি।’ কি করবেন আর শ্বশুর মশাই মরিচ ভর্তা দিয়ে ভাত খেয়ে নিলো। আর অবাক নয়নে জামায়ের গোস্ত খাওয়ার গল্প শুনলো। গল্পটি স্যার নিজে আমার বন্ধুর কাছে করেছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয়নি। এতো খাবার কি করে খাওয়া সম্ভব! আমার বন্ধু আরও বললো,‘ শুধু কি তাই সম্প্রতি বগুড়া কোয়ালিটি বিরিয়ানি হাউজ থেকে সাড়ে সাতশ টাকার বিরিয়ানি বকর স্যার অনায়সে খেয়েছেন, যেখানে সাধারণত এক কোয়াটার বিরিয়ানি খেলে পেট ভরে যায় । আর যেখানে স্যার খেছে ১৫ প্যাকেট বিরিয়ানি। তুমি বিশ্বাস না করলে আমারও কিচ্ছু যায় আসে না এবং বকর স্যারেরও কিচ্ছু যায় আসে না।’ আমি আমার বন্ধুকে বললাম, আসলে সে মানুষ না খাদক প্রাণি। আমার বন্ধু বললো, ‘আমি তোমাকে স্যারের খাওয়ার একটা প্রমাণ দেখাবো আমার বড়ো ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে। সেদিন তুমি বিশ্বাস না করে যাবে কোথায়?’ আমি বকর স্যারকে কখনো দেখিনি । স্যারকে দেখার জন্য মনের মধ্যে বেশ আকুলি-বিকুলি করছিলো । আমি বেশ কৌতুহলি হয়ে উঠলাম, কবে যে আমার বন্ধুর বড়ো ভাইয়ের বিয়ে আসবে আর আমি আমার কাঙ্খিত সেই খাদক স্যারকে দেখবো।
আমার এক চাচা আছেন সে খুব খেতে পারেন। দারুণ পেটুক। শুনেছি আগে চাচার সংসার বেশ ভালোই ছিলো । জমি-জমাও ভালো ছিলো কিন্তু চাচার অভ্যাস ছিলো ভয়ানক খারাপ। দেদারছে টাকা খরচ করতো। বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ঘুরতো আর ভুরিভোজ করতো। এক সময়ে এসে চাচার সব সম্পদ ফুরিয়ে নি:শ্ব হয়ে গিয়েছিলো, সে জন্য পরবর্তিতে এসে চাচাকে অন্যের বাড়িতে দিন মজুরের কাজ করতে হয়েছে কিন্তু খাওয়ার অভ্যাস চাচা তখনো বদলাতে পারেনি। এজন্য প্রবাদে বলে, ‘কয়লা ধুলে ময়লা যায় না।’ চাচা একদিন এক গেরেস্তোর বাড়িতে কামলা দিয়েছে, গেরেস্তোর সেদিন কামলা হওয়ার কথা চাচাসহ তিনজন কিন্তু অন্য দু’জনের সমস্যা থাকার কারণে কাজে আসতে পারেনি। গেরেস্তো জানে, কামলা হয়েছে তিনজন, তাই তিন কামলার ভাত নিয়ে গেছে চড়ায়। তখন সকাল দশটা কিংবা সাড়ে দশটা বাজে। চাচাকে খুব ক্ষুধা পেয়েছে। চাচা খুব বড়ো-সরো মানুষ, তাই কাজ-কাম তার কোনো ব্যাপার না। তিন জনের ভাত দেখে চাচা খুব খুশি হলো এবং গেরেস্তোকে সব খাবার খেয়ে ফেলবে বলে দিলো । গেরেস্তো আগে থেকেই তাকে চেনে ও জানে। তাই তাকে খাবার সায় দিলো এবং হাসলো। চাচা এবার ধান ক্ষেতের পানিতে হাত ধূয়ে উঁচু জমিতে উঠে উপর দিকে একটি লাফ দিলো এবং বললো ‘বা এ বাতাসে মার পেট দরিয়ে হয়ে যা।’ এই মন্ত্রটি বলে খাবার শুরু করে দিলো । চাচা তিন জনের খাবার অনায়সে একবারেই খেয়ে ফেললো । আমার চাচাও একটা বড়ো খাদক ছিলো।
সত্যি সত্যি হালকা শীতের প্রারম্ভে বিয়েয়ের দিন তারিখ ঠিক হলো আমার বন্ধুর বড়ো ভাইয়ের এবং একই দিনে বিয়ে ও খাওয়ার দাওয়াত কনের বাড়িতে । বিয়ের বাড়িতেই বকর স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয় করে দিলো আমার বন্ধু এবং ঘটনা ক্রমে একই টেবিলে আমরা খাওয়ার জন্য বসলাম আমি আমার বন্ধু এবং বকর স্যার। খাবার পরিবেশন হলো । আমরা খাচ্ছি কোনো কথা বলছিনা ,আমি শুধু নিরবে আড়চোখে স্যারের খাওয়া দেখছি। গোস্ত ও বিরিয়ানির গামলা সামনে রাখা যে যতো পারে খাবো কোনো বাঁধা নেই। আমি ও আমার বন্ধু প্রথমে যতোটুকুন নিয়েছি তাতেই খাওয়া শেষ। আর বকর স্যার আস্তে আস্তে টেবিলে যা ছিলো সব খেলেন আরেক ডিস আনানো হলো ওয়েটারকে দিয়ে সেটাও শেষ এবং ঐ বেচের সব মানুষের খাওয়া শেষ কিন্তু খাওয়া শেষ করেননি বকর স্যার। স্যার পিটপিট করে বললেন ,‘ খাওয়ার সময় এতা তাড়াতাড়ি করা ঠিক না এবং এতে সুন্দর মতো খাওয়া যায় না।’ আমি বললাম, স্যার আরও লাগবে নাকি আপনার ? স্যার শুধু বললেন, ‘আপনারা তাড়াতাড়ি শেষ করলেন আমি কেমন করে বসে বসে খাই, এটা কি হয়?’
আমি একটুখানি হেসে দিলাম । কিন্তু বকর স্যারের খাওয়ার আক্ষেপ থেকেই গেলো । স্যার হয়তো আমাদের সম্মান রক্ষা করলেন। আমার বন্ধু আমাকে কানে কনে বললো ‘দোস্ত এবার বিশ্বাস হলো।’ আমি বললাম, হুম।
No comments