চিঠি ❑ কিশোর কুমার পন্ডিত
চিঠি
❑
কিশোর
কুমার পন্ডিত
❑
হইতে
মধুপুর
তারিখ:২১/০৫/২০২১
প্রিয়
বন্ধু খালেক,
আশা করি ভালো আছিস। আসলে কে কতটা ভালো আছে সেটা কেবল ভুক্তভোগীই জানে। তবুও বাহিরে সবার ভালো থাকতেই হয়। হঠাৎ সেই ছোটবেলার দিনগুলির কথা মনে পরে গেল। তোর মনে আছে দূর্গা পূজার দিন এলে তুই আমাদের বাড়িতে তিন দিন থাকতি। কত আমোদ-প্রমোদ, আনন্দ হতো ।
রাতে যখন ভূইয়া বাড়ি পূজার মন্ডপে আলতি দেখতে যেতাম সেখানে কতই না আনন্দ হতো। তোর মনে আছে সেদিন তুই ছোট নাটিকায় অভিনয় করেছিলি।সেখানে তুই বিরাট গোঁফ দিয়ে মুখে কালি মেখে মহিষাসুর সেজেছিলি।দিনের বেলায় শরতের শুভ্র মেঘের ছুটোছুটি দেখতাম নদীর পাড়ে বসে। পাল তোলা নৌকার বিচরণ দেখতাম নদীর ঘাটে। এই তিনদিন মা শুধু আমাদের খাওয়ার সময় কাছে পেতেন। তুই বরাবরের মতই তিন দিন থাকবি বলে মা আমাদের খাওয়ার জন্য কত আইটেমই না তৈরি করতেন।নাড়ু,মোয়া ,নারিকেলের তক্তি,দুধের ছানার সন্দেশ। ভাতের সাথে থাকতো মুরগির ঝোল ।তোর কি মনে আছে ঈদে আমিও তোদের বাড়ি যেতাম ? আমি কিন্তু তখন তোদের বাড়িতে দুইদিন থাকতাম।চাচি কত আদরই না করতেন আমাকে।ঈদের পরের দিন নদীতে গোসল করতে যেতাম দুইজনে। সাঁতরিয়ে পার হতাম ছোট নদী । একদিন চাচিও কিন্তু আমাদের সাথে গিয়েছিল নদীর ঘাটে। তখন বোধহয় আমরা ক্লাস সিক্সে পড়ি।চাচি আমাদের জোর করে ধরে সাবান গায়ে মেখে গোসল করিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর নদীতে আর বেশি সময় থাকতে দিলেন না।তারপর দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার ধুম ।সেদিনকার সকালের কলার পিঠার কথা এখনো আমার মনে পড়ে। আজ মনে পড়ে বাউল সম্রাটের সেই বিখ্যাত গানের কথা -
গ্রামের
নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া
বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম
আগে
কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।
সেই
দিনগুলি আর রইল না। আর কি জীবনে ফিরে আসবে সেই দিনগুলি ? আগের দিনগুলির কথা শুধু
স্মৃতিতেই রয়ে গেল।
তারপর
দিন গেল আমরাও বড় হতে থাকলাম। জীবনের সাথে যুদ্ধ করে ঠিক করলাম জীবনের কর্ম। আমি
প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হলাম আর তুই হলি পলিটেকনিক পাস করে সাব এসিস্ট্যান্ট
ইঞ্জিনিয়ার ।
শোন
অন্য কথা থাক একটা গোপন কথা বলি। নিবেদিতা এসেছিল,ওর কথা তোর তো নিশ্চয়ই মনে আছে।
আমরা যখন এসএসসিতে ও তখন অষ্টমে। আমরা যখন এইসএসসি পাশ করলাম ও তখন এসএসসি পাস করল
।ইন্টার মিডিয়েট দিয়ে রেজাল্টের অপেক্ষায় বসে আছি এই সময়টাতে ওদের বাড়ির পাশ
দিয়ে কতইনা ঘুরঘুর করেছি। তোর মনে আছে ওদের টিনের চালের মাটির বেড়ার একটি ঘর
ছিল। ওর রুমে কেবল একটি ছোট জানালা ছিল । ঘরের পিছনে ছিল একটি পুকুর।তারপরে বড়
কাঁচা রাস্তা।আমরা কয়েক জন বিকেল হলেই গিয়ে বসতাম কাঁচা রাস্তার এক চিলতে ঘাসের
উপর। অর্ধেক ঘাসে অর্ধেক মাটিতে বসতাম।শরৎকালে ওই পুকুরে কি অদ্ভুত পদ্ম ফুলই না
ফুটত। পড়ন্ত বিকেলে সূর্য যখন তার শেষ আলোর বিচ্ছুরণটা ওই পদ্ম পুকুরে দিত তখন
চিকচিক জলে আর ফুলে কি দৃশ্যটাই না হত। তার উপর আবার পুকুরের ওপারেই নিবেদিতাদের
ঘরের জানালা, আর সে জানালায় নিবেদিতা দাঁড়িয়ে আছে।ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে
থাকতাম জানালার দিকে । ছোট জানালা অন্ধকার ঘর স্পষ্ট বোঝা যেত না জানালায় কে
দাঁড়িয়ে আছে,কিন্তু মনের অন্তস্থল থেকে মন শুধু সারা দিত ওটা নিবেদিতাই। তোর কি
মনে পড়ে একদিন আশ্বিনের বিকেলে বড় রাস্তায় বসে আছি হঠাৎ শরতের ঝমঝম বৃষ্টি।
সেদিন আমরা তিনজন ছিলাম। শেষে সাহস করে নিবেদিতাদের বাড়ি গিয়েছিলাম অনেক ভয়
উপেক্ষা করে। সেদিন ওর বাবা-মা বাড়ি ছিল না। শুধু ওর বড় বোন বাড়ি ছিল উনি
আমাদের ঘরে বসতে দিয়ে গা মুছতে গামছা দিলেন। তুই আমাকে কনুই দিয়ে খোঁচা মেরে
বললি এই তো সুযোগ কাছে যা। আমি ভয়ে ভয়ে নিবেদিতার কাছে গেলাম। নিবেদিতা অতি
স্নেহের আদরে ওর গায়ের ওড়নার আঁচল এগিয়ে দিল আমার মাথা মুছতে আর রেগে গিয়ে বলল
বৃষ্টি দেখে বাড়িতে আসলেই তো পারতে এমন ভাবে শেয়াল ভেজা হতে হতো না। নিবেদিতার
গায়ের ওড়না দিয়ে আমার মাথা মুছে আমার হৃদয়ে কি রোমান্স কি আনন্দ শরীর যেন
বারবার শিহরণ দিয়ে উঠলো ।সেদিনই ভালো বাসার মর্ম বুঝে ছিলাম। হয়তো সেদিনই
বুঝেছিলাম ভালোবাসা কারে কয়। আমি যেদিন বিএ পাস করে প্রাইমারিতে চাকরি নিলাম
নিবেদিতা তখন অনার্স ফাইনাল দিল। একদিন জারুল বনে মাধবীলতা সনে আমরা দুজনে গোপন
অভিসারে মিলিত হয়েছিলাম। আমি বললাম বধু সেজে কবে আমার ঘরে যাবে গো? নিবেদিতা বলল
আমিতো তোমারি অপেক্ষায় তোমারি ইশারার দিকে চেয়ে আছি। তারপর দুজন দুজনের কাছে
প্রতিশ্রুত হয়ে সেদিন বিদায় নিলাম। নিবেদিতার পরিবার সব জেনে গেল। তারা
প্রাইমারি শিক্ষক এর কাছে মেয়ে দিতে চাইল না। তাই তারা তাদের কথামতো কানাডা
প্রবাসী এক ছেলের কাছে নিবেদিতাকে বিয়ে দিয়ে দিল। সেদিন থেকেই নিবেদিতা কানাডা
প্রবাসী। নিবেদিতা কথা রাখেনি। কাব্যিক ভাষায় মনে মনে আক্ষেপ করে বলেছিলাম -
ময়ূরপুচ্ছ
মুকুট সাজে চুয়া চন্দন মাঝে
মিথ্যেভাষিনী
সেজেছে আজ পর বধুয়া সাজে।
আমার
দুয়ার ছাড়িল পাল্কি আমারে না জিগায় দূরদেশে যায় দূরাভিসারিকা পরের ইশারায়।
ওর
একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে। ওরা কানাডায় থাকে। ওর জীবনটাও এক বিরাট
ট্রাজেডির। কানাডায় ওর স্বামী কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। শুনেছি ও নাকি ওদের
গ্রামের বাড়িতেই থাকবে। কি আর বয়স হয়েছে ওর চল্লিশ কি বিয়াল্লিশ। আমার মনে
হয়েছিল ও যেন আগের মতনই আছে। মহাজনরা বলেন প্রেমের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ প্রেম
হচ্ছে পরকীয়া। পরকীয়া প্রেমেই প্রেমের আসল রস আসল মজা। নিবেদিতার যৌবন আর মন যেন
আমাকে ইশারা দিয়েছিল পরকীয়ায় মজতে। তুইই বল এ সুযোগে কে না চাইবে এ প্রেমে ডুবে
মরতে। কিন্তু সমাজের অনেকেই তা পারে না। আমরা শিক্ষক আমরাতো আরো পারি না। আর তাই
ওর সাথে আর দেখাই করিনি। মনে আফসোস রয়ে গেল সেই নিবেদিতা এল যখন আমি পঞ্চাশে।
শোন
শেষের কথায় আসি,এবছর চাকরির শেষ বর্ষে পদার্পন করেছি। বয়স ষাটের কাছাকাছি হল।
এখন হাটে, মাঠে -ঘাটে ,অফিস-আদালতে, শহরে ,গঞ্জে যেখানেই যাই আমার চেয়ে বেশি
বয়সের লোক খুব একটা দেখিনা। ভাবে বুঝি আধাপাকা চুল আর শরীরের চামড়া কুঁচকে
যাওয়া ভাব এসে গেছে। দাঁত না পড়লেও কোন কোনটা হয়ত আলগা হয়েছে। একমাত্র
ভজনালয়ে গিয়ে দেখি আমার চেয়ে বেশির ভাগই বয়সে বড়রা মনে মনে স্বর্গের আশা
বাঁধছে। পাকা চুলে ফোকলা দাঁতে চামড়া কুঁচকানো লোকেরা এখন আমাকে ইশারা দেয় বন্ধু
হতে। মনে পড়ল সেই কোন এক পাগলের গানের কথা-
দিনার
দিন গেল তোমার হেলায় ফেলায় মেতে
একদিনও
ভাবলিনা সেই দিনের কথা।
সেই
দিনের আর কয়দিন বাকি
দেহ
ছেড়ে যাবে পাখি
দেখবি
রে মন সবই ফাঁকি
সবই
ছলনা।
কেনরে
মন সাধুর সঙ্গ নিলিনা।
তাই
আমিও সাধুসঙ্গ নেবার চেষ্টা করছি এ ভব পারাপার পাড়ি দেওয়ার আশায় । আশায়
বেঁধেছি বুক আমিও দুঃসাহসী সেই স্বর্গের আশায়।
মনের
আবেগে এই আধুনিক তথ্য প্রবাহের যুগে পুরনো চিঠি লেখার অভ্যাসটার সাহস দেখালাম।
অনেক কিছুই লিখে ফেললাম। আশা করি সম্পূর্ণ চিঠিটা পড়বি। আর শেষবার আমাকে একটা
চিঠি লিখে জানাবি গাজীপুরে কেমন আছিস। গাজীপুরেই তো জীবনের বেশি সময় কাটালি ।
জীবন সায়াহ্নে এসে হিসাবের খাতায় যোগ-বিয়োগ কেমন হলো কি পেলি আর কি হারালি
নিশ্চয়ই লিখে জানাবি। আজ লেখা শেষ করলাম।
ইতি
তোর
বন্ধু রতন ।
No comments