Header Ads

ধর্ষণ ব্যাধিতে আক্রান্ত বাংলাদেশ

ধর্ষণ ব্যাধিতে আক্রান্ত বাংলাদেশ
দেলোয়ারের নেতৃত্বে একদল যুবক ও কিশোর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে ভিডিও করেছে।এক মাস আগে ২ সেপ্টেম্বর সংঘটিত এই ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুর্বৃত্তরা নিজেরা ছড়িয়ে না দিলে কেউ জানতেও পারতো না।দ্বিতীয় বিয়ে করায় স্বামীর বাড়ী ত্যাগ করে এই গৃহবধূ বাপের বাড়ী চলে আসেন; স্থানীয় যুবক দেলোয়ার ছাড়াও বাদল, কালাম ও তাদের আরও কিছু সহযোগী তাকে উত্ত্যক্ত করতে থাকে, কিন্তু তাদের অশালীন প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায় তারা উক্ত গৃহবধূকে অপমান করার সুযোগ খুঁজতে থাকে।মহিলার স্বামী কিছুদিন পর আবার আসা-যাওয়া শুরু করলে স্থানীয় যুবকগুলো অনৈতিক কাজের অভিযোগ এনে ঐ নারীকে মারধর শুরু করে এবং একপর্যায়ে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করে।মা’র বয়সী একজন নারীর উলঙ্গ দেহ ভিডিও করে অপরাধীরা এক মাস দাপটের সাথে এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছে, তারুণ্যের উত্তেজনায় ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ না করলে আমৃত্যু তাদের এই অপরাধ ঢাকা পড়ে থাকতো।ভুক্তভোগী নারী তো প্রকাশ করতোই না।দেলোয়ারের লাম্পট্যপনা সম্পর্কে তার মা, বাবা, চাচা-চাচী সবাই অবহিত- ভুক্তভোগী গৃহবধূ সবাইকে জানিয়েছে, একটু প্রতিকারের প্রত্যাশায়।কিন্তু কিচ্ছু হয়নি, কেউ কোন প্রতিকার করেনি। ফলে দেলোয়ারের দাপট সম্পর্কে তার জানার বাকি ছিলো না।বিবস্ত্র করে নির্যাতন করার আগে দেলোয়ার এই গৃহবধূকে দুইবার ধর্ষণও করেছিল।ভয়ের এমন আবহ সৃষ্টি হয়েছিলো যে, ডাক দেয়ার সাথে সাথে দেলোয়ারের নৌকায় গিয়ে এই গৃহবধূ দেহদানে বাধ্য হয়েছে।
কী দেশ, কী সমাজ, কী প্রশাসন।গ্রেফতারের পর সবাই এখন দেলোয়ারের কীর্তি কাহিনী প্রচারে নেমেছে; সে নাকি একটি সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান।কিন্তু এই ঘটনার আগে দেলোয়ারের অস্তিত্ব কারো নজরে আসেনি।ওয়ার্ড মেম্বারের কাছে ধর্ষণের নালিশ করার পর চুপ থাকতে নির্দেশ দেয়া হয় ধর্ষিতাকে।ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, থানার ওসি, উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, এসপি, জেলা প্রশাসক, এমপি- মনে হচ্ছে এরা কেউ দেলোয়ারকে আগে চিনতেন না, জানতেন না।এখন নাকি তার কাছে অস্ত্রও পাওয়া গেছে।এত দিন এত অপরাধ করার পরও দেলোয়ারকে না জানার অপরাধে এদের কারো বিচার হবে না।কারণ তারা সবাই বড় বড় আমলা আর জনপ্রতিনিধি।জনপ্রতিনিধি হতে হলে জনতার প্রয়োজন হয় না, প্রয়োজন হয় দেলোয়ারের।আসলে সমাজটাই পচে গেছে, দেলোয়ার ও তার বন্ধুদের অপকর্ম সমাজপতিদের নজরে পড়ে না।দেলোয়ারের প্রভাব প্রতিপত্তিতে তার মা-বাবার সামাজিক কদর নিশ্চয়ই বেড়ে গেছে।রাস্তায় বের হলে মসজিদের ইমাম, স্কুলের শিক্ষক আগ বাড়িয়ে এসে তার বাবাকে নিশ্চয়ই সালাম দিয়ে থাকেন, সামাজিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে এক নম্বরে থাকে দেলোয়ারের বাবার নাম।দেশের সর্বত্র একই অবস্থা।কক্সবাজারে এক ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা ৭২ বছরের এক প্রবীণ ব্যক্তিকে বিবস্ত্র করে মারধর করেছে।ঘটনা ঘটার পর জানা গেল যুবলীগ নেতা আনছুর আলম একজন ডাকাত ও বিভিন্ন মামলার আসামি।
কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার পোড়াদহ ইউনিয়নের সিরাজুল ইসলাম দারুল উলুম মরিয়ম নেছা মহিলা আবাসিক মাদ্রাসার সুপার মাওলানা আব্দুল কাদের ৪ সেপ্টেম্বর ভোর পাঁচটা ও রাত আটটায় তের বছর বয়সী তার এক আবাসিক মাদ্রাসা ছাত্রীকে তার কক্ষে ডেকে নিয়ে উপর্যুপরি ধর্ষণ করেছেন।সিলেটের শিবগঞ্জ মজুমদার পাড়ায় ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রকে বলাৎকার করেছে এক মাদ্রাসার শিক্ষক।মাদ্রাসা মাদ্রাসায় এমন ধর্ষণ ও বলাৎকার প্রতিদিন প্রতিনিয়ত হচ্ছে।মাদ্রাসায় সাধারণত গরীব ঘরের সন্তানেরা লেখাপড়া করে থাকে, হুজুরদের প্রতি এই সকল পরিবারের সদস্যদের অগাধ বিশ্বাস, ভক্তি ও আনুগত্য রয়েছে, অন্যদিকে এই গরীব পরিবারগুলোর প্রতিবাদ করার সাহস নেই।এই সকল দুর্বলতা হুজুরদের জানা থাকে বলেই ধর্ষণ ও বলাৎকার করতে ভয় পায় না।
বস্তির কিশোরদের নষ্ট হওয়ার পেছনে দায়ী অভাব।বস্তিতে বসবাসকারী কোন কিশোর তার মা-বাবার তত্ত্বাবধানে বড় হয় না।অধিকাংশ মা বাসায় বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করে থাকেন, বাবা ঠেলাগাড়ী বা ভ্যান চালায়- তাদের সন্তান ছোটকাল থেকে রাস্তায় সমবয়সীদের সাথে মারামারি করতে করতে বড় হয়।এরা মা-বাবাকে একটুও কেয়ার করে না।একটু লায়েক হওয়ার পর এলাকায় দলবেঁধে চলাফেরা করার অহঙ্কার এদের অপ্রতিরোধ্য সাহসী করে তোলে।এরা দলবেঁধে পার্টি অফিসে বসে আড্ডা দেয়, নেতাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে; কার সন্তান, কোথায় থাকে কেউ জানতেও চায় না।এরা দলবেঁধে হাঁটার সময় সবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে, অট্টহাসিসহ এরা জোরে জোরে কথা বলে থাকে।পাড়ার রাজনৈতিক বড় ভাইদের সাথে এরা সুসম্পর্ক রাখে।রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকার কারণে পুলিশ এদের ধরে না।নেতাদের আশির্বাদ থাকায় অপরাধ করলেও তাদের কোনো সাজা হবে না- এমন ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠে।
নারীকে হীন করে দেখার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি নতুন কোন উপসর্গ নয়।ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ করে আজ পর্যন্ত কোন নারী পরিবার ও সমাজে সন্মানিত হয়নি।ধর্ষিতা মেয়েরা মা’র কাছে অবহেলিত, বাবার কাছে অনাদৃত, ভাই-বোনদের কাছে অস্পৃশ্য, সমাজের কাছে অপাঙ্তেয়- কোন অনুষ্ঠানে তাদের সঙ্গী করা হয় না, কেউ বেড়াতে এলে তাকে লুকিয়ে রাখা হয়।সমাজ তো নারীর মধ্যে শুধু অপরাধই খুঁজে বেড়ায়।সমাজের ধারণা, মেয়েরা ঠোঁটে লিপিস্টিক না পরলে পুরুষের জোশ বাড়তো না, তারা সুগন্ধি লাগিয়ে চুল ছেড়ে দিয়ে রাস্তায় লাফালাফি না করলে পুরুষেরা শান্তই থাকতো।ফিটফাট পোষাক পরা নারীর উপর ঝাপিয়ে পড়ার জন্য সমাজ পুরুষদের দায়ী করতে নারাজ।সমাজেরও দোষ নেই, মেয়েদের উপর পুরুষদের আধিপত্যের স্বীকৃতি ধর্মেও রয়েছে।যুদ্ধে ধর্ষণ করার হালাল ইতিহাস কাউকে বিস্মিত করে না।একাত্তরে পাকিস্তানি মুসলমানেরা নির্বিচারে বাঙ্গালী মহিলাদের ধর্ষণ করেছে; অতি সম্প্রতি রোহিঙ্গা মহিলাদের ধর্ষণ করেছে মিয়ানমারের বৌদ্ধ সেনারা।ভিয়েতনামী মহিলাদের ধর্ষণ করেছে আমেরিকান সেনাবাহিনী, কুয়েত দখল করে সেখানকার মেয়েদের ধর্ষণ করেছে ইরাকি সেনা, কোরিয়ার মেয়েদের ধর্ষণ করেছে জাপানি সেনা।পৃথিবীর যেখানেই যুদ্ধ হয়েছে সেখানেই যুদ্ধরত সেনারা টার্গেট করেছে মেয়ে জাতিকে।
অপরাধ ও অধরাধীর সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতাকে দায়ী করা হয়ে থাকে।বিচার ব্যবস্থাকে সম্প্রসারিত ও সুসংগঠিত করার কোন পদক্ষেপ কোন সরকার কখনো কেন নেয়নি তা আমাদের মতো সাধারণ লোকের কাছে একটি দুর্জ্ঞেয় বিষয়।ক্ষুধাবৃত্তির মতো যৌনাকাঙ্ক্ষাও মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি।আমাদের দেশে এটাকে লজ্জার আবরণে সর্বদা ঢেকে রাখার চেষ্টা করা হয়ে থাকে।ছেলেমেয়েদের একত্রে চলাফেরা করতে দেয়া হয় না, সহশিক্ষা নিষিদ্ধ, প্রেমিক-প্রেমিকা পার্কে বসলে শুধু মাস্তান নয়, পুলিশও চাঁদা দাবী করে।কোটি কোটি ধর্ষণের পর সম্প্রতি আমরা প্রতিবাদে নেমেছি, ফেইসবুকে নিজের প্রোফাইল কালো বা অন্ধকার করেছি।কিন্তু মাদ্রাসার কিছু লম্পট শিক্ষকদের মতো সুযোগ সন্ধানী হয়ে আলো থেকে আমাদের অন্ধকারে যাওয়া যথার্থ কী না তা দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে।কারণ ফেইসবুকের সবাই বিশ্বাসী বন্ধু নই।আমরা সবাই এখন ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড চাচ্ছি।কিন্তু মৃত্যুদণ্ড চাওয়ার মতো আমরা সবাই কি সহি? ফেইসবুকে ধর্ষকের বিচার চেয়ে স্ট্যাটাস দিয়ে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ উত্তরের সহসভাপতি নিজেই গৃহকর্মী ধর্ষণের দায়ে সম্প্রতি গ্রেফতার হয়েছেন।সমাজে এত শয়তান থাকলে পাপ যাবে না।শয়তানের মৃত্যু নেই।পাপ করার পর ক্ষমা প্রার্থনাকারী বান্দাকে আল্লাহ পছন্দ করেন, আমরা যদি পাপ না করি তাহলে আল্লাহ আমাদের পরিবর্তে এমন এক জাতি আনয়ন করবেন, যারা পাপ করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে।তাই চলুন, সবাই মিলে ক্ষমা প্রার্থনা করি- এটাই সহজ পথ।যিনা কবিরা গুনাহ, মৃত্যুদণ্ডেও মাফ হবে না, একমাত্র তাওবাহ কবুল হলে মাফ হবে।
লেখক বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী
পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক
ahmedzeauddin0@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.