Header Ads

চেনা অচেনা _ ভালোবাসার গল্প


চেনা অচেনা

রাত ন'টা।শীতের রাত। সমাপন তার বন্ধু সমীরকে কল করতেই বিপরীত দিক থেকে এক নারী কন্ঠের আওয়াজ। সমাপন মুঠোফোনে লক্ষ্য করল তার বন্ধুর নম্বর নয়। বুঝল ভুল নম্বরে কল করেছে সে। বিপরীত দিক থেকে কল কাটা হল না। তাই আলাপ হল। কিছুক্ষণ পর বিপরীত দিক থেকেই কল কেটে দেওয়া হল। ২২ বছরের যুবক সমাপন অনার্সের ছাত্র। মনে মনে একই চিন্তা কাল লাইনে কে ছিল। তাই সাহস করে পরের দিন আবার একই সময়ে ঐ নম্বরে কল করল। বিপরীত দিক থেকে আবারাে সেই সুরেলা নারী কণ্ঠ। 

সমাপন জিজ্ঞাসা করল কে আপনি? কোথায় থেকে বলছেন? নারী কণ্ঠ বলল, আমি সুরভি। সাগরদাঁড়ি থেকে। কপােতাক্ষ পাড়ের মেয়ে আমি। আপনি? আমি সমাপন। মধুপুর থেকে। বংশাই পাড়ের ছেলে আমি। এভাবে কয়েকদিন সমাপন ও সুরভির মধ্যে কথা হল। তারপর প্রেম। 

তাদের প্রেম ছ'মাস চলল। কিন্তু দেখা হল না। শেষে একদিন সমাপন কথা দিল সে আসবে সুরভির সাথে দেখা করতে। যেদিন সমাপন সুরভির সাথে দেখা করবে বলে ঠিক করল তার আগের দিন তার বন্ধু সমীর বলল, কাল তারা পাত্রী দেখতে যাবে। সমাপন কিছুতেই রাজী হচ্ছিল না। ঘনিষ্ঠ বন্ধুর জোরাজোরিতে সমাপন তার বন্ধুর সাথে মানিকগঞ্জে চলে গেল। 

পাত্রী দেখা শুরু হল। কেউ কোন প্রশ্ন করার সাহস পাচ্ছিল না। হঠাৎ তাদেরই এক বন্ধু প্রশ্ন করল, আপনার বয়স কত ? এ প্রশ্নে সবাই হতবাগ। প্রশ্নে বােঝাই গেল পাত্রীর বয়স বেশী। পাত্রী দেখা শেষে এল খাওয়া দাওয়ার পালা। ডাইনিং টেবিলে খাওয়া দাওয়া হচ্ছিল। ডাইনিং টেবিলের বিপরীত পাশেই ছিল ড্রেসিং টেবিল। সমাপন খাবার চেয়ারে বসে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় অন্য ঘরে বসে থাকা একটি মেয়েকে দেখতে পেল। 

সমাপনের হৃদয়টা যেন একটু আনচান করে ওঠল। তার কেবলি মনে হল এ যেন কত যুগের চেনা। লম্বা গড়ন , গায়ের রং ফর্সা , মেঘকালাে চুল বয়স আনুমানিক ১৮। সব দেখে সমাপন যেন দিওয়ানা হয়ে গেল। সমীরের পাত্রী পছন্দ হল না। সমাপনের পাত্রী পছন্দ হল। সমাপন তার বন্ধুদের সব খুলে বলল। বন্ধুরা তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে বলল। কিন্তু প্রথম দেখাতেই এরকম প্রস্তাব দিতে সাহস পেল না সমাপন। 

মন যে মানে না। তাই পাগলের মত প্রস্তাব দিয়ে বসল সে। কিন্তু সুজলা এ প্রস্তাবে যেন ক্ষেপে গেল। পাশ কাটিয়ে গেল তাকে। নামটি পর্যন্ত শােনল না তার। সমাপন আশা ছাড়ল না। সে সমীরকে বুঝিয়ে আবার মানিকগঞ্জে গেল। সমাপন, সুজলার কাছে গেল এবং আগের প্রস্তাব আবার দিল। কিন্তু এবারও সে ব্যর্থ হল।

অনেক জ্বালাতন সহ্য করে শেষে সুজলাই সমাপনকে বলল এটা সম্ভব নয় , কারণ সে অন্য কাউকে ভালােবাসে। এবার সমাপনের সকল চেষ্টা ব্যর্থ। হলো। মনে পড়ল সুরভিকে। নিজেকে ভর্ৎসনা করল বারবার। ভাবলাে সুরভিকে সে ঠকিয়েছে। তারা বাড়ি ফিরে গেল। বাড়ি ফিরেই সমাপন সুরভিকে কল করল। কিন্তু সুরভিকে পাওয়া গেল না। তার মােবাইলের সুইচ অফ। 

সমাপন সুরভির মােবাইলে তিনমাস ট্রাই করল। সুরভির মােবাইলের সুইচ অফ দেখাল। সমাপন খুব চিন্তি ত হল। সুজলা মােবাইলে প্রেম করে এ কথা বাড়ির সবাই জানত। তাই মেয়েটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এ কথা চিন্তা করে তার অভিভাবকরা সুজলার বিয়ে ঠিক করে ফেলল। ছেলে বিদেশ ফেরত। অনেক বিত্ত বৈভবের মালিক। কিন্তু সুজলার মায়ের বিদেশী ছেলে পছন্দ ছিল না। তাই বিয়ের দুদিন আগে মা মধুছন্দা মেয়েকে চালাকি করে মােবাইলটা ফেরত দিয়েতার পছন্দের ছেলেকে কল করতে বললেন। সুজলা শেষবারের মত ছেলেটিকে কল করল। সমাপন মােবাইল উঠাতেই দেখল সুরভির কল। সে মহা আনন্দে কল রিসিভ করল। 

সুরভি কেঁদে কেঁদে বলল , তুমি তাে আসলে না। কথা দিয়ে কথা রাখলে না। আগামী পড়শু আমার বিয়ে। ।সমাপনের সকল চিন্তা কেটে গেল। সে বলল , কেঁদো না লক্ষ্মীটি , চিন্তা করাে না। আমি আসছি। যেভাবেই হােক আমি ওখান থেকে তােমাকে নিয়ে আসবাে। সুজলার সকল চিন্তা সমাপনের মাথা তোকে দূর হয়ে গেছে। সে শুধু সুরভি কে চায়। কিভাবে সুরভিকে পাওয়া যায় এই চিন্তায় বিভাের হয়ে গেল। 

সকল চিন্তা ঝেরে ফেলে পরদিন সকালেই সে মাইকেলের দেশে রওয়ানা হলাে। পথে হলাে নানান বিপত্তি। ফেরী পার হতে গাড়ির দীর্ঘ লাইন। তাদের গাড়ি নাকি সিরিয়াল পাবে পরদিন সকালে। তাই সমাপন গাড়ি থেকে নেমে হেঁটেই চলল ফেরীঘাটে। দীর্ঘ ৪ কিলােমিটার হেঁটে আসল নদীর পাড়ে। ছােট নৌকা দিয়ে পার হলাে প্রমত্তা পদ্মা। এভাবে ছােট নৌকা দিয়ে এত বড় নদী সে কোনদিন পার হয়নি। সে প্রেমের টানে সুরভির কাছে যাওয়ার সাহস দেখাল। 

সমাপন যখন রূপকথার সাত সাগর আর তেরাে নদী পারি দিয়ে স্বপ্নের কন্যার দেশে পৌছাল তখন বিকেল ৪ টা। কপােতাক্ষ পাড়ে গিয়ে অনেকের কাছে জিজ্ঞাসা করল সুরভির কথা। কিন্তু এখানে কেউ সুরভির কথা বলতে পারল না। তারা সুরভি নামে কাউকে চিনে না। শেষে সমাপন বলল, এখানে কপােতাক্ষ পাড়ে কোন বাড়িতে কী কোন মেয়ের বিয়ে হচ্ছে বলতে পারেন? ঝাকা মাথায় একটা রােগাটে লােক বলল, দক্ষিণ পাড়ায় নিতাই ঘােষের মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। 

সমাপন আশা নিরাশায় দোদোল্যমান হয়ে দক্ষিণ পাড়ার দিকে ছুটল। বিয়ে বাড়ির হুলুস্থুল। তখনাে বর আসেনি। সমাপন সাহস করে বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ল। ঢুকেই তার চোখ স্থির হয়ে গেল। এ বাড়ির যে মেয়ের বিয়ে হচ্ছে তার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল তার। একি এখানে সুজলা ! সুজলাকে দেখে সমাপন থ মেরে গেল। 

সুজলাও সমাপনকে দেখে অবাক হয়ে গেল এবং সাথে সাথে রেগেও গেল। সুজলাই প্রথম বলল, তুমি? তুমি এখানে? সমাপনও যেন একই প্রশ্ন করল। তুমি এখানে কেন? তােমাকে তাে দেখেছি মানিকগঞ্জে। এ বাড়িতে তুমি কিভাবে? 

সুজলা বলল, মানিকগঞ্জে আমার মামার বাড়ি। ইন্টারমিডিয়েট ফাইনাল দিয়ে সেখানে আমি দু মাস ছিলাম। সুজলা আরও বলল, এখন বুঝেছি তুমি ওখান থেকে ঠিকানা জোগাড় করে এখানে এসেছ আমার বিয়ে ভাঙতে, তাই না? এবার সমাপন কোন কথা বলল না। সে খুব লজ্জা পেল এবং ভাবলাে সে ভুল ঠিকানায় এসেছে। এটা সুরভিদের বাড়ি নয়। তাই সে মাথা নিচু করে সেখান থেকে চলে যাচ্ছিল। সুজলা রাগে আর দুঃখে আরেকবার মােবাইলে কল করল। 

সে দেখল ফিরে যাওয়া ছেলেটির পকেটে মােবাইলের রিং টোন বাজছে। সে চমকে উঠলাে। সে কী! তাহলে এই কী সমাপন! সমাপন কল রিসিভ করল। সুজলা বলল, তুমি আসলে না তাহলে? সমাপন বলল, আমিতাে এসেছি তুমি কোথায়? সুজলা বলল পিছন ফিরে তাকাও আমি এখানে। সমাপন পিছন ফিরে তাকাতেই দেখল সুজলা অশ্রুসজল নয়নে আনন্দ অশ্রুতে কেঁদে তার দিকেই আসছে। সুজলা বলল , আমার ভুল হয়েছে আমাকে মাপ করাে এতাে কাছে থেকেও আমি তােমাকে চিনতে পারি নি। 

সমাপন বলল , কিন্তু আমি তাে তােমার কাছে আসিনি। আমি এসেছি সুরভির কাছে। সুজলা বলল , আমায় ক্ষমা করাে আমি সুরভি নামটি তােমাকে বানিয়ে বলেছিলাম। আসলে আমার নাম সুরভি নয় সুজলা। সকল সন্দেহের সুরাহা হলাে। সমাপন সুজলার দিকে তাকাল সুজলা সমাপনের দিকে। মধুছন্দা তাদেরকে পালাতে সাহায্য করল। যখন তারা কপােতাক্ষ পাড় দিয়ে যাচ্ছিল তখন সূর্য লালাভ। সূর্যের রং আর নদীর দু'ধারের পলাশ ও শিমুল ফুলের রং একাকার হয়ে আরেকবার মধুর ফাল্গুন মধুর পিরিতিকে স্বাগত জানাল। 

কিশোর কুমার পণ্ডিত


No comments

Powered by Blogger.