অবচেতন মন
অবচেতন মন
বন্ধু পিন্টু আর রুমেলের ওপর প্রচণ্ড রাগ হলো, ভাবলাম ওদের সাথে অন্তত তিন মাস কথা বলবোনা। এমন কেউ করে! গত দুমাস আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছি-শরতের ছুটিতে তিনজন সুন্দরবন যাবো। কোথায় কী! এল তো না-ই, আসতে যে পারবেনা তাও চিঠিতে জানায়নি পর্যন্ত। কিন্তু হায় যে ঘটনা পরের মাসে ঘটল তা আগেই যদি জানতে পারতাম, রাগের বদলে সারাজীবন এক কষ্ট বুকে নিয়ে চলতে হবে, তাহলে....।সে যাক্ গে, পরে আসছি সে কথায়।
আশ্বিনের শেষ। দু সপ্তাহের ছুটি পেয়েছি।আগে থেকেই স্থির করা ছিল-তিনজন মিলে সুন্দরবন যাব; ক্যাম্পিং এর জিনিসপত্র কেনার ভার আমার ওপর ছিল। তাই নির্দিষ্ট দিনে ওরা না আসায় হতাশ তো হয়েছিই, অভিমান হয়েছে প্রচণ্ড।
পিন্টুর বাড়ি বাগেরহাট আর রুমেলের মেহেরপুর। এইচ এস-সি পরীক্ষার আগে আমাদের দেখা হয় কলকাতায়।আমরা সবাই চিকিৎসা করতে গিয়েছিলাম। কথায় কথায় তিনজনেই বন্ধু হয়ে যাই, বাড়ির ঠিকানা দিয়ে আমি চলে আসি জুলাইয়ের শেষে।
কিন্তু আকস্মিক এক ঘটনায় আমার সমস্ত অভিমান গলে জল হয়ে গেল।
আমি পুকুর পাড়ের জামরুল গাছ থেকে জামরুল ছিঁড়ছিলাম, হঠাৎ চোখে পড়ে একটি রিকশা আমাদের বাড়ির দিকে আসছে।
রিকশার আরোহী আর কেউ নয়-পিন্টু আর রুমেল।দৌড়ে গিয়েই একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম। আব্বু-আম্মু খুব খুশি হলো।
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে বেড়াতে বেরুলাম।উদ্দেশ্য গ্রামের সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি ক্যাম্পিং এর পরিকল্পনা ঠিক করা।
আমাদের গ্রামটা দ্বীপের মত, চারপাশে সবুজ ধান ক্ষেত, দিগন্তে জেলে পাড়া , মৌলভী পাড়া আর রসুলপুর গ্রাম। কার্তিকে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্যে তিন বন্ধু বিমোহিত হয়ে ভাবছিলাম এত সুন্দর কেমনে হয় প্রকৃতি। কিন্তু আকস্মিক এক ঘটনায় আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম তার পাশেই রেললাইন। তিনজনেই এপারে দাঁড়িয়েছি। রেলের সিগন্যাল শুনে অপেক্ষা করছিলাম ট্রেন চলে যাবার। হঠাৎ পিন্টু আর রুমেল রেল লাইনের উপর দৌড়ান শুরু করল। আমি ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ হয়ে গেলাম। ট্রেন যেদিক থেকে আসছিল ওরা সেদিকেই দৌড়াচ্ছে, যেন মজার এক খেলা।
আমি চিৎকার করে উঠলাম। দুপাশে তখন লোকজন জমে গেছে। তারা আমাকে দেখছিল এমনভাবে যেন পাগল দেখছে। এক ভদ্রলোক আমায় জিজ্ঞেস করলেন, আমি ঠিক আছি কিনা!
আমি আঙুল দিয়ে দেখালাম বন্ধুদের। বললাম, এটা মজা করার সময় নয়। দয়া করে ওদের থামান। সাত- আট সেকেন্ডে ঘটনা যা ঘটার তাতো ঘটে যাবে।
ঠিক এই সময়েই ট্রেনটা দুরন্ত বেগে ছুটে বেরিয়ে গেল। আর ! আর আমার বন্ধু দুজনের গগনভেদী চিৎকারে আমিও মুর্ছিত হয়ে পড়লাম ।
আমার যখন জ্ঞান হয় তখন আমার চারপাশে অনেক লোকজন দেখতে পেলাম।
ধাতস্থ হতে সময় লাগল।
কে একজন বললেন, আমি রেল লাইনের পাশে পড়ে ছিলাম অচেতন হয়ে। সবাই এক বাক্যে স্বীকার করলেন, আমি যেন পাগলের মত কারো সাথে কথা বলছিলাম । আমার আশেপাশে কেউ ছিলনা, আর কেউ ট্রেনে কাটাও পড়েনি!
আমি প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলাম, ঠিক এমন সময় চিঠি হাতে একজন লোক এসে বললেন, ভাই আপনার একটা রেজিস্ট্রি চিঠি আছে।
চিঠি পড়ে আমি আবার জ্ঞান হারালাম।
চিঠিটিতে যা লেখা ছিল তা হুবহু লিখে দিলাম।
বাবা নীল, আশা করি আল্লাহ্’র রহমতে ভাল আছ। বিশেষ আর কী লিখব! পিন্টু আর রুমেলের যাওয়ার কথা ছিল তোমার ওখানে। ক্ষমা করে দিও। ওরা যেতে পারেনি, কারণ ওরা অন্য জায়গায় চলে গিয়েছে। ভারতে চিকিৎসা শেষে ফেরার পথে দুজনেই ট্রেন এক্সিডেন্টে ......। তুমি ভাল থেকো । পারলে যোগাযোগ করো।
বিশেষ আর কী!
ইতি
তোমার চাচা মতলুব আলী।
মদনদা যখন গল্পটা শেষ করলেন আমি তখন কাঁদছি। বাইরে তখন শীতের রাত। গাঢ় অন্ধকারে আমার ভেজা চোখ তিনি দেখেছেন বলে মনে হয়না।
ঈশান বাউণ্ডুলে
No comments