মীর সাহেবের সরাই ❑ সেলিম ইসলাম খান ❑ ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব_২৬
মীর সাহেবের সরাই
সেলিম ইসলাম খান
❑
উপন্যাস
গভীর রাত। চারদিক
ঘুটঘুটে অন্ধকার। চাটগাঁ বন্দরে শুনশান নিরবতা বিরাজ করছে। আরব বণিকদের অস্থায়ী
তাঁবুতে বন্দী মগহার্মাদ সর্দার শাচীনের মনে আজ আনন্দের ঢেউ। বন্দরের ভেড়ি বাঁধের
জঙ্গলে শিয়ালের ডাক তাকে সজাগ করে দিয়েছিল। সে শিয়ালের মত ধূর্ত এক ফন্দি আঁটল।
প্রহরীরা গভীর ঘুমে অচেতন। লোহার খাঁচায় বন্দী শাচিন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই
খাঁচাতে করেই তারা নিরীহ মানুষদের ধরে নিয়ে রেঙ্গুনের বাজারে বিক্রি করত। নিজেদের
তৈরি খাঁচায় শাচীন নিজেই আজ বন্দী। খাঁচার উপরের দিকে ছিল একটি বিশাল মশাল।
শাচীনের হাত পা ছিল শেকলে বন্দী। সে খাঁচার রড বেয়ে মশাল অবধি উঠল। বেশ
কষ্টেশিষ্টে মশালটি পেড়ে নিল সে। মশালের আগুনে হাত পায়ের শিকল কাটল। তারপর বেশ
ক্ষণ সময় ব্যয় করে খাঁচার তালাও পোড়াল। তারপর অনায়াসে বেরিয়ে এল সে। ঘুমন্তু
প্রহরীর খাপ থেকে তলোয়ার বের করে অযথাই তাদের গলায় চালিয়ে দিল। প্রহরীরা এমনিতেই
ঘুমে বেহুঁশ ছিল। তারপর তাঁবুর পেছন দিক দিয়ে পালিয়ে ঘন জঙ্গলে চলে গেল। তার হাতে
পায়ে এখনো লোহার শেকলের খাড়ু লাগানো রয়েছে। জংলা ফেরিয়ে পা টানতে টানতে সে জমির আল
ধরে দক্ষিণের দিকে ছুটল। এখানকার পথঘাট সবই তার চেনা। যতদিন বন্দর মগহার্মাদদের
নিয়ন্ত্রণে ছিল, ততদিন সেও এই বন্দরের আশপাশ চষে বেড়িয়েছে। কোথাও কোন মানুষকে
শান্তিতে থাকতে দেয়নি। কারো গরু, কারো ছাগল, কারো যুবতী কন্যা কারোবা শিশুদের কেড়ে
নিয়ে গেছে সে। তাই আরব বণিকরা এতদূর ধরতে নস পারলেও স্থানীয়রা তাকে কিমা বানিয়ে
খাবে। অতএব ভোরের আলো ফোটার আগেই তাকে দক্ষিণের সৈকতে পৌঁছতে হবে। সেখানে সাগরে
মাছধরার নৌকার অভাব হবে না। এই তলোয়ারের আঘাতে মাঝির মাথা কেটে তার নৌকা নিয়ে
পালানো কঠিন কোন কাজ নয়।
এসব যখন শাচীন ভাবছিল,
তখন দূরে, তার রেখে আসা জায়গা থেকে ঢংঢং ঘন্টার সতর্ক সংকেত ভেসে এল। শাচীন ভয়
পেয়ে আরো জোরে দৌড়াতে চেষ্টা করল। কিন্তু পায়ের শেকলের খাড়ুগুলো তার গতি কমিয়ে
দিল।
বন্দরের দিক থেকে মশাল
হাতে আবর সেনারা চারদিক ছড়িয়ে গেল। ততক্ষণে শাচীন লোকালয় ফেরিয়ে দক্ষিণের সৈকতে
এসে পড়েছে। সামনেই সাগর তীরে জেলে নৌকা বাঁধা। শাচীনকে ধরবে সে সাধ্য এখন কারও
নেই। মনে মনে সে হাসে, আর দ্রুত পা চালায়। কিছুক্ষণের মধ্যে সে সবচেয়ে বড় নৌকাটির
কাছে যায়। কারণ সন্দ্বীপ যেতে হলে তার বড় নৌকা চাই। নৌকার ছইয়ের ভিতর দুজন জেলে
ঘুমোচ্ছে। শাচীন তাদের গলায় তলোয়ার চালিয়ে দিল। ঘুমের ঘোরে গোবেচারা কিছুই বুঝে
উঠতে পারল না। প্রশান্তির ঘুমের মাঝেই চিরকালীন প্রস্থান লাভ করল তারা। শচীন নৌকায়
উঠে নোঙরের রশি কেটে দিল। তারপর দ্রুত দাঁড় বাইতে লাগল। কিছুদূর যাওয়ার পর লাশ
দুটিকে লাথি মেরে সাগরে ফেলে দিল। তারপর ক্রুর হাসি হেসে উঠল। আহ কি শান্তি! এখন
সন্দ্বীপ গিয়ে অংপ্রুর সাথে মিলে বন্দীত্বের প্রতিশোধ নিবে সে।দুপুরের তপ্ত রোদে
উষ্ণ সাগরে নৌকা বাইতে বাইতে সন্দ্বীপ পৌছে গেল শাচীন। সৈকতের কাছাকাছি আসার পর সে
দুহাতের ক্রসভঙ্গী করে সে সংকেত দিল জাতভাইদের। নইলে সুলতানী বাহিনীর আক্রমণ ভেবে
মগতীরন্দাজরা তাকে মেরে ফেলবে। সংকেত মনপুত হওয়ায় সৈকতে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। তারা
উলুধ্বনির মাধ্যমে শাচীনকে স্বাগত জানাল।
সৈকতের মগসেনাদের
হর্ষধ্বনির সাথে সে সর্দার অংপ্রুর তাঁবুতে পৌঁছল। অংপ্রু তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে
ধরে খুশিতে নাচতে লাগল। তারপর ঝিনুকের স্যুপ আর লইট্টা মাছের ঝোল দিয়ে মধ্যাহ্ন
ভোজ সারল তারা। খাবার শেষে চাটগাঁ আক্রমণের আলোচনায় বসল তারা।
অংপ্রুর মত হল সরাসরি
বন্দরে হামলা করা। কিন্তু শাচীন বলল, আগে চারপাশের গ্রামে হামলা করে তাদের
মানসিকভাবে দুর্বল করে দিতে হবে। তারপর সেনা তাঁবুতে হামলা চালিয়ে সহজেই বিজয় লাভ
সম্ভব হবে।
অন্যরা একমত হওয়ায়
শাচীনের ফর্মুলা গৃহীত হল।
পরিকল্পনাবঅনুযায়ী
সন্ধ্যা নামার আগেই তারা পাতাংগা সৈকতে পৌঁছে গেল। তারপর জংলাভূমি পেরিয়ে
জেলেপাড়ার দিকে অগ্রসর হল। ধানের জমিতে ঘাপটি মেরে বসে রইল তারা। জেলেপাড়ার লোকজন
রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়েছে। অনেকের চোখে কাঁচা ঘুম। কেউ আবার সাগরে মাছ ধরে
ক্লান্ত হয়ে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল।
হঠাৎ চারদিক থেকে বিভৎস
উলুধ্বনির শব্দে পুরো জেলে পাড়া জেগেবউঠল। সবাই চোখ খুলেই নিজেদের ঘরে একাধিক
মগহার্মাদ দেখতে পেল, যারা তখন উলুধ্বনি দিচ্ছিল। ভয়ে তারা শোয়া থেকেই উঠতে
পারেনি। বল্লমের আঘাতে জোয়ানরা প্রাণ হারাতে লাগল। আর মহিলা, শিশু ও বৃদ্ধরা অসহায়
আত্মসমর্পণ করল। মগহার্মাদরা তাদের সবাইকে লোহার শেকলে বেঁধে ফেলল। তারপর বেশ
কিছুক্ষণ ধরে চলল লুটপাত। সবশেষে পাড়ার প্রতি ঘরে আগুন দেয়া হল। আগুনের লেলিহান
অগ্নিশিখা পেছনে ফেলে জেলে নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা চাবুকের আঘাত খেতে খেতে শেকল টেনে
এগিয়ে আলল সৈকতের দিকে। মগহার্মাদরা ক্রুর হাসি হেসে বলল, চল তোদের রেখে বণিক
পল্লীতে হামলা করব শেষ রাতে। সবশেষে বন্দরে হামলা করব। বাহ কি মজা হবে। অংপ্রু
বলল, আলফা আর গফুর তোরা কই! এবার তোদের চিবিয়ে খাব আমি।
চলবে........
No comments