অবন্তিকা ❑ উপন্যাস ❑ কিশোর পণ্ডিত ❑ পর্ব ০৩
উপন্যাস
অবন্তিকা
কিশোর
পণ্ডিত
পার্থ অফিস করছে আর বাসায় ফিরছে এভাবে একমাস কাল কেটে গেল । আর তার অন্তরে একটা আশা ধীরে ধীরে বাসা বাঁধতে থাকলাে । সে আশা আর কিছুই নয় অবন্তিকে নিয়ে । অবন্তিকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে একদিন তার মায়ের কথা মনে পড়ে গেল । তাই সে বাড়ীতে চাকুরীর এক মাসের বেতন আর একটা চিঠি লিখে তা ডাকে ছেড়ে দিল । পার্থ যেদিন তার মায়ের কাছে চিঠি লিখছিল সেদিন হঠাৎ করে অবন্তি তার রুমে ঢুকে পড়েছিল ,অবন্তি রুমে ঢুকেই দেখতে পেল পার্থ কাগজে চিঠি লিখছে । তাই সে পার্থকে আড়াল করে ধীরে ধীরে নরম পায়ে হেঁটে তার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল । সে যা ভেবেছিল তা নয় । পার্থ তার মায়ের কাছে চিঠি লিখছে । পার্থর সেদিন মনে হয়েছিল অবন্তির কথাও সে লিখে দেবে । যখন সে অবন্তির কথা লিখবে কি না ভাবছিল তখন অবন্তির সাড়া সে পেল । অবন্তি তাকে বলল মায়ের কাছে চিঠি লিখতে এত কি ভাবছেন । সে যে কি ভাবছে সে কথাটা তাকে পার্থর বলতে ইচ্ছা হল । কিন্তু সাহস পেল না । তাই সে কথার কোন উত্তর না দিয়ে আবার চিঠি লেখায় মন দিল । ততক্ষণে অবন্তি আবার তার নিজের রুমে চলে গেল । পার্থ তাকে সেদিন আর ডেকে ফিরাল না । কারণ তাকে ডেকে ফিরালে পার্থর চিঠি লেখা হবে না । কিন্তু অবন্তি যখন চলে গেল পার্থ কিন্তু তার যাওয়ার পথে হা করে তাকিয়ে ছিল । তখন তার কেন জানি খারাপ লেগেছিল । যুথিকা রানী ছেলের চিঠি পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল। । সে চিঠিটা কয়েকবার পড়লো । পার্থ ভাল আছে এটাই তার কাছে সুখের ব্যাপার । সে যে চাকুরীর টাকা পাঠিয়েছে তাতে সে অত খুশী নয় । কিন্তু পার্থ কোথায় কিভাবে আছে তা কিন্তু পার্থ সেবার চিঠিতে লিখেনি । পার্থের ঠিকানা কি ? তা কিন্তু চিঠিতে নেই । হয়তাে ঠিকানা থাকলে ভাল হতাে । প্রয়ােজনে সে চিঠি লিখে খোঁজ খবর ভালাে করে নিতে পারতো । এই ভেবে তার মনটা কিছু খারাপ হলো । আবার এই ভেবে মনকে সান্ত্বনা দিল হয়তাে তার ছেলে ঠিকানা লিখতে ভুলে গেছে । আর এখনই বা অত ঠিকানার প্রয়ােজন কিসের । চিঠি যখন একবার এসেছে পরের চিঠিতে ঠিকানা অবশ্যই থাকবে । ছেলের খবর পেয়ে যুথীকার তার স্বামীর কথা মনে পড়ে যায় । আজ তার বাবা বেঁচে থাকলে এই বয়সেই অত অল্প লেখাপড়ায় বাড়ী ছাড়তে দিতেন না ছেলেকে । যুথিকার মনে পড়ে পার্থের আগমনী খবর যেদিন সে তার স্বামীকে দেয় তখন কত খুশীই না হয়েছিলেন তিনি । তিনি বলেছিলেন ছেলেকে মানুষের মত মানুষ করবেন । তখন যুদ্ধ বাধেনি । যুদ্ধের যেন সাজ সাজ রব । এদেশের মানুষের মুখে মুখে যেন স্বাধীনতার আলাপচারিতা । সকলেই দেশটাকে স্বাধীন করার চিন্তায় মগ্ন । যেখানে যেদিন মিটিং মিছিল হতাে পার্থের বাবা সেখানেই উপস্থিত থাকতাে সকলের আগে । খুব একটা দিন সংসার হয়নি তাদের । কিন্তু পরিচয় ছিল তাদের অনেকদিনের । তখনাে স্বাধীনতার মর্ম বুঝেনি যুথিকা । সবার মুখে একটাই বােল স্বাধীনতা , স্বাধীন দেশ । তার স্বামী সময় পেলেই তার সাথে স্বাধীনতা নিয়ে আলাপ করত স্বাধীনতার সুফল , পরাধীনতার কুফল , কিভাবে আমরা অন্য দেশ দ্বারা শােষিত হচ্ছি ইত্যাদি বুঝাত । তারই নানা আলােচনায় কিছু কিছু বুঝে উঠেছিল যুথিকা । সে বুঝেছিল স্বাধীনতা মানে দেশকে অপরের শৃঙ্খল হতে মুক্ত করা । দেশ স্বাধীন হলে এ দেশের মানুষ হবে সুখি ও সুন্দর আর অন্যের নাগপাশ হতে মুক্ত হবে । নিজের ইচ্ছামত সবকিছু করতে পারবে । এদেশের সম্পদ এদেশেই থাকবে । বেকারেরা কাজ পাবে , আর কর্মীরা পাবে তার কর্মের অধিকার । অভাব , গঞ্জনা , বঞ্চনা থাকবে না । অন্যের তাবেদারী থাকবে না । আমাদের কেউ ঠকাতে পারবে না । সব মিলিয়ে দেশটা হবে সুন্দর আর সুখকর জীবনের স্থান । কিন্তু সে যা বুঝেছিল তার স্বামীর বক্তব্যে আজ তা তার বিশ্বাস হচ্ছে না । তাই যদি হতাে তাহলে দেশের অবস্থা আজ এমন কেন। কেন সারা দেশে এত হা হা কার । কারাে মুখের দিকে যেন তাকানাে যায় না । শান্তি যেন কোথাও নাই । কেউ শান্তিতে নাই । খুব কঠিন চিন্তায় মশগুল হয়ে যায় যুথিকা । দেশ নিয়ে ভাবনা এক কঠিন ভাবনা । হঠাৎ সব চিন্তা বাদ দেয় সে । সে বুঝে ঐ অতবড় চিন্তা তার মাথায় ধরবে না । তবুও এসে যায় তার স্বামীর কথা মনে হলেই । কি পেল সে । কি পেল তার পরিবার ।কি পেল দেশ । এসবই তাকে ভাবিয়ে তুলে । যাহােক তবুও তাে দেশটা স্বাধীন হয়েছে । এ এক মহান পাওয়া । তারই জন্যে ভুলে থাকে যুথিকা সব । যুথিকা আবার ছেলের চিঠি পড়ে । সে ভাল আছে । এই তার সান্ত্বনা । চিঠিটা আর টাকাগুলো গোপনে রেখে বাইরে বেরিয়ে যায় সে । তার প্রতিদিনের কাজের সাথে মিশিয়ে নেয় নিজেকে । প্রতিদিনের কাজের মধ্যে তার ছিল দুটি ছাগী দেখাশুনা করা । আগে তিনটি ছিল এখন দুটি । পার্থ যখন শহরে যায় তখন একটি বিক্রি করতে হয় । তাই আজও সে তার অমল কাকাদের বাড়ীর পাশ দিয়ে মাঠে যাচ্ছে । অমল কাকাদের বাড়ীর বাইর বাড়ী দিয়ে যখন যুথিকা যায় তখন তার খুব খারাপলাগে । অমল বাবুরা আজ আর এ বাড়ীতে থাকে না । যুদ্ধের পাঁচ বছর পরই ইন্ডিয়া চলে গেছে । এই বাড়ীর উঠোনে যুথিকা কত খেলেছে নন্দিতার সাথে । নন্দিতা অমল বাবুর ছােট মেয়ে । তার জীবনটাও একটা ট্রাজেডি । নন্দিতা ভালবেসেছিল এক নমশুদ্রের ছেলেকে । অমল বাবু সে ভালবাসা মেনে নেয়নি । সেই ছেলে সেদিন ব্যর্থ হয়ে পরে বিয়ে করে , সেই রাতেই নন্দিতা যুথিকাদের পুকুর পাড়ের বড় আমগাছটার উঁচুডালে ফাঁসি দিয়ে মরে । যুথিকার সে করুণ দৃশ্য আজও দুই চোখে ভেসে উঠে । বাড়ীর ভিতরে উঠানের দিকে তাকাতেই যুথিকার চোখে পড়ে এক কালাে ছিমছিমে রােগা এক লােকের দিকে । প্রথমে যুথিকা চিনতে পারেনি তাকে । ভাল করে নজর দিয়ে তাকাতেই চিনতে পারে লােকটিকে । বলরাম দা ,তুই কবে কখন এলি ? ইন্ডিয়া থেকে এসেছিস ? প্রশ্ন করে যুথিকা । হ্যাঁ কাল এসেছি বাংলাদেশে । আজ এসেছি বিহারপুরে বাপের ভিটা দেখতে । উত্তর দেয় অমলবাবুর সেজ ছেলে বলরাম । অমলবাবুর সেজ ছেলে বলরাম আগে কেমন ধব ধবে ফর্সা স্বাস্থ্যবান ছিল । আজ তার একি হাল । তাের এমন অবস্থা কেন ? প্রশ্ন করে যুথিকা । এদেশ থেকে চলে যাওয়ার পর তারা ওদেশে ভাল অবস্থা করতে পারেনি । পরে অর্ধাহারে অনাহারে তার পিত্তরােগ হয়েছে । সেই থেকেই তার এই হাল বলে জানায় বলরাম । চল আমাদের বাড়ীতে চল । মাঠ থেকে ছাগী নিয়ে এসে যুথিকা বলরামকে সাথে নিয়ে বাড়ীতে চলে আসে । বলরামকে হাত পা ধােয়ার জল দিয়ে রাঁধতে বসে যুথিকা বলরামকে খাওয়াবে বলে । বলরামদের বাড়ী নন্দিতার সাথে কত খেয়েছে যুথিকা । তারপর ভাত খেতে খেতে দুজনে পূর্ব স্মৃতির আলাপ করে কখনাে খুশী হয় আবার দুঃখের স্মৃতিতে কাঁদে । এভাবে তারা সেদিন সময় কাটাল । কোথায় উঠেছিস বলরাম দা ? প্রশ্ন করে যুথিকা । বড় দিদির বাড়ী প্রসাদপুর ,উত্তর দেয় বলরাম । কবে চলে যাবি ? জানি না । কেন জানিস না ? কোথায় যাব , কি করে খাব , দেহ কি আছে বলতেই চোখে জল ভরে যায় বলরামের । যুথিকাও কাঁদে । পরে বলে ভগবানের ইচ্ছা ,তিনি যাকে চান হাসান আবার যাকে চান কাঁদান তার লীলা বুঝা বড় দায় । আমাদের দুঃখ দেওয়াই যেন তার আনন্দ । আবার কাউকে চিরকাল সুখী রাখাই তার আনন্দ । তার কর্ম মানুষ বুঝে সাধ্য কি । ভগবানের আনন্দ চিরকালের । তার দুঃখতাে নেই । তাই কারাে দুঃখে তার আনন্দ আবার কারাে সুখে তার আনন্দ । ভগবান তুমি সুখে থেকো বলে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে যুথিকা । বলরাম চলে যায় তার দিদির বাড়ী । যুথিকা বিদায় দেয় । তার চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে থাকে ।
মানুষের জীবনে কখন সুখ আসে আবার কখন দুঃখ আসে মানুষ তা বলতে পারে না। কিন্তু ভগবান তা জানেন নিশ্চিত । বলরামের কখন সুখ ছিল চিন্তা করে যুথিকা । হ্যাঁ তারও সুখ ছিল , তাদের পরিবার সুখি ছিল । তবে তা যুদ্ধের আগে । অমল বাবুর পরিবারকে সুখি দেখেছে যুথিকা নিজ চোখে । আবার তাদের দুঃখও দেখেছে তারই চোখে । যুথিকার মনে আছে । এই সেই বলরাম যে তার স্বামীর মৃত্যু সংবাদ দেয় । সে বলেছে কখন কিভাবে সে মুক্তিযুদ্ধে যায় । সে বলেছিল নভেম্বরের মাঝামাঝির দিকে ১৮ জনের এক মুক্তিবাহিনী দল পাক হানাদারদের ব্যাংকার দখল করতে পারেনি। হানাদারদের সমরসাজ আর অনেক সৈন্য সংখ্যা ছিল। আক্রমন করতেই প্রবল বাধার সম্মুখীন হয় । যখন তাদের শক্তিশালী অবস্থান বুঝতে পারে তখন পালিয়ে আসতেই বীরেশ্বর গুলি খেয়ে মারা যায় । তার লাশ তারা দুই জনে ডিঙ্গি নৌকায় কত কষ্টে এনে শবদাহ করে মুক্তিযুদ্ধাদের ঘাটিতে ।
মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে অনেক কাহিনী বলেছে বলরাম । সে বলেছে একদিন একরাতে দুই রাজাকার এক বিধবা মহিলার যুবতী মেয়েকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছিল ,তখন আমি আর বীরশ্বের এক বাড়ী থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছিলাম । এই না দেখে বীরেশ্বর গেল ক্ষেপে । অতিদ্রুত কমান্ডারকে খবর দিল সে । কমান্ডার তার সাথীদের নিয়ে এসে তাদের ধরে ফেলল । রাজাকারদ্বয় কমান্ডারের চেনা । কমান্ডার তাদের প্রাণ ভিক্ষা দিলেন । তিনি আমাকে ও বীরেশ্বরকে বললনে ওদের সাড়া রাত পুকুরের জলে ভিজিয়ে রেখে সকালে ছেড়ে দিও । আমরা করলাম উল্টোটা । কিছু পিটানাে দিয়ে জলে ভিজিয়ে রেখে সকালে বেধে রাখলাম । পরে আবার রাতে ভিজিয়ে রেখে সকালে বেধে রেখে এভাবে দুইদিন পর ছেড়ে দিয়েছিলাম । যুথিকার মনে আক্ষেপ জাগে কতনা নাম না জানা মুক্তিযােদ্ধা রয়েছে । বলরাম তাদের একজন । দেশ স্বাধীন বলরামরা ঠিকই করেছিল কিন্তু দেশ বলরামদের কিছুই দিল না । নাম না জানা মুক্তিযােদ্ধা বলরাম এখন দেশ ছাড়া । যে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিল , যে দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রেখেছিল ,সে দেশতাে স্বাধীন , কিন্তু তার স্বাধীনতা কোথায় । তার স্বাধীনতা পরাধীন । সে নাম না জানা মুক্তিযোদ্ধা পিত্তরােগী বলরাম । দিন চলে যায় রাত আসে ।যুথিকা ঘুমিয়ে যায় আরেক দিনের আশায়।
চলবে.......
No comments