একদিন ছুটি হবে _ শামছুন ফৌজিয়া
একদিন ছুটি হবে
শামছুন ফৌজিয়া
————————-
আজ কদিন থেকে রাফি চুপচাপ হয়ে আছে, কারো সাথে তেমন কথা বলেনা । খেলতে ও যায়না , অবশ্য খেলতে যাবার সুযোগ নেই তারা ফ্লাটে ভাড়া থাকে আর লকডাউন চলছে। রাফি চতুর্থ শ্রেণীতে উঠেছে সেটা কোন পরীক্ষা না দিয়েই। নয় বছরের রাফির স্কুল বন্ধ গত এক বছর ধরে। স্কুলের টিচাররা মোবাইলে যোগাযোগ করেন আর প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন। অনলাইনে ক্লাস দিচ্ছেন টিচাররা সেটার লিংক পেয়ে রাফির মা বাবা ছেলেকে দেখতে দেন। তবু যেন রাফির মন ভরেনা।
সারাদিন মাকে কত প্রশ্ন করে রাফি মা কবে স্কুল খুলবে ? রাফির মা মিসেস শাহিদা একজন গৃহিনী আর বাবা মিস্টার রেজা একজন ব্যাংকার । রাফিকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন তাদের। একমাত্র ছেলের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য যা প্রয়োজন তা করতে তারা প্রস্তুত। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারীতে সব কিছু যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। রাফির জন্য অনেক চিন্তা তাদের।
ছোট্ট রাফি ঘুমিয়ে আছে ! কি নিষ্পাপ মুখ। শাহিদা বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর ভাবছেন কবে যে সবকিছু স্বাভাবিক হবে আর ছেলের স্কুল খুলবে ? শাহিদা বেগম নিজে একজন গ্র্যাজুযেট তাই ছেলের জন্য স্বামীর সাথে আলাপ করে একটি রুটিন তৈরি করেছেন । সারাদিন রাফি কি কি করবে কোন সাবজেক্ট পড়বে আর কখন টিভি দেখবে , খেলবে আর পরিবারের সাথে সময় কাটাবে সব কিছু ঐ রুটিনে আছে। কিন্তু একমাত্র ছেলে বলে অনেক সময় আদর করে রুটিন হতে কাটছাঁট দিতে হয়। কিন্তু তবু ছেলের মন যেন কেমন বিষন্ন থাকে হাসি খুশি ভাবটা খুঁজে পাননা ওর মুখে।
রাফির প্রচণ্ড জ্বর আর জ্বরের জন্য আবোল তাবোল বকেই যাচ্ছে। রেজা সাহেব টেম্পারেচার দেখে ঔষধ দিচ্ছেন আর শাহিদা বেগম রাফির কপালে জলপট্টি দিচ্ছেন। ফোনে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ চলছে আর সেইমত চিকিৎসা দিচ্ছেন। মাঝ রাতে রাফির জ্বর নামল এবং ঘেমেছে প্রচুর। মায়ের উদ্বিগ্ন মন ছেলের জ্বল কমায় যেন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। তিনি গা মুছে দিলেন আর জামা চেন্জ করে দিয়ে একটু লেবুর জুস খেতে দিলেন ছেলেকে। রাফি দু চুমুক দিয়ে জানায় আর খাবেনা। রাফি বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়ে ও যেন পড়ে যাচ্ছিল । তা দেখে মা তাকে ধরে নিয়ে গেলেন বাথরুমে । রাফি শুয়ে শুয়ে মাকে বলছে, মা আমি সুস্থ হয়ে স্কুলে যাব।
শাহিদা বললেন, অবশ্যই যাবে ! স্কুল তো আছেই যখন খুলবে তখন সবাই যাবে।
রাফি বলল, সেদিন রিমি ম্যাডাম বলেছেন তিনিরা মাঝে মাঝে স্কুলে যান।
আমি পীযুষ আর মাহিনকে বলেছি একদিন আমরা যাব স্কুলে।
শাহিদা বললেন, তুমি সুস্থ হয়ে নাও তখন যাবে।
রাফির চোখে জল টলমল করছে, শাহিদা বেগম তা দেখে বললেন , কি হল চোখে জল কেন রাফি? তুমি স্কুল খুব ভালোবাসো বুঝি ?
রাফি বলল, হ্যাঁ মা আমি স্কুল খুব ভালোবাসি।স্কুলে গেলে বুঝি করোনা হয়ে যাবে ?
শাহিদা বললেন, তোমাকে তো বলেছি আমাদের সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবেই। সোশ্যাল ডিসটেন্স রেখে প্রয়োজনে বাইরে যেতে হবে। তাই সরকার তোমাদের কথা ভেবেই স্কুল বন্ধ রেখেছেন।করোনার একজন রোগী যদি বাইরে চলাফেরা করেন তাহলে অন্যকে ও সংক্রমিত করবেন তিনি। তাই যতদিন সবকিছু স্বাভাবিক না হচ্ছে ঘরে থাকতেই হবে বাবা।
রাফি বলল, মা আমি ঘুমাবো।
শাহিদা বেগমের চোখের কোনে জল চিকচিক করছে তবু ছেলেকে মানষিক শক্তি যুগিয়েই যাচ্ছেন তিনি।
সকালে রাফিকে তৈরি করে দিলেন শাহিদা বেগম । টেবিলে নাস্তা দিলেন কিন্তু রাফি তেমন কিছুই খেলোনা। রেজা সাহেবের অফিস করতে হয় কখনো ঘর হতে কখনো ইনপারসন। তিনি আজ অফিসে যাবেন, যাবার আগে রাফিকে আদর করে মায়ের কথা শুনতে বললেন।
শাহিদা বেগম ছেলেকে বেশি প্রাধান্য দেন বলে সংসারের কাজগুলো কম সময়ে দ্রুত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কদিন থেকে তিনির নিজের মন ও খারাপ। লকডাউনে আর করোনা পরিস্থিতিতে মাকে হাতে গোনা দু তিনবার দেখে এসেছিলেন। কিন্তু ভয়ে বাইরে যেতে মন চায়না । বাইরে অনেক লোকের ভিড় থাকে আর কেউ যেন কোন আইন মানছেনা। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা মোটেও হচ্ছেনা। মাস্কের ব্যবহার খুব কম, যারা কিছু পরেন তা ও অনেক সময় থুতনীর মাঝে দিয়ে রাখেন। সেদিন রেজা ও বলছিলেন , অফিসের একজন নাকি মাস্ক পকেটে রেখে দিয়েছেন, অনেক অনুরোধের পর ও পরেননি। শিক্ষিত সচেতন মানুষেরা এমন করলে হতদরিদ্র অসচেতন মানুষেরা মাস্ক পরবেই বা কেন ?
রাফিকে অনলাইনের ক্লাস ওপেন করে দিয়ে শাহিদা ঘরের কাজ করতে লাগলেন। কিছু সময় পরপর উঁকি দিয়ে রাফিকে দেখছিলেন। হঠাৎ দেখলেন রাফি মোবাইলে ক্লাস না দেখে অন্যমনস্ক হয়ে জানালা দিয়ে চেয়ে আছে। শাহিদা বেগম ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন, বললেন কি হয়েছে তোমার মন খারাপ ?
রাফি বলল, মা আমি অনলাইন ক্লাস দেখবনা, আমি স্কুলে যাব।
শাহিদা বললেন, ঠিক আছে আজ আর পড়তে হবেনা। আজ তোমার টিচারের সাথে কথা বলিয়ে দেব।
রাফি ভীষণ খুশি হল টিচারের সাথে কথা বলবে শুনে।
শিশুরা সব সময় টিচারদের ফলো করে। টিচাররা কেমন করে লিখেন, কথা বলেন সব তারা কপি করে।দুপুরে রাফি কথা বলল মিলি ম্যাডামের সাথে। মিলি ম্যাডাম তাকে খুব আদর করতেন। মিলি ম্যাডাম বললেন, রাফি তুমি একদম মন খারাপ করবেনা। একদিন করোনা শেষ হয়ে যাবে দেখো তখন আমরা সবাই স্কুলে যাব। এখন ধৈয্য ধরে মায়ের কথা শুনো, ঘরে থাকো।
রাফির মন একটু হলে ও ভালো হয়ে গেলো।
রেজা সাহেব ঘরে এসে সোজা হাতমুখ ধুয়ে গোসল সেরে বসার রুমে আসেন যখন বাইরে যান। আজ ও একই কাজ করে রাফির খোঁজ নিলেন কেমন আছে? টিচারের সাথে কথা হয়েছে শুনে তিনি বললেন, আমি তোমার টিচার বাদল সাহেবের সাথে কথা বলেছি। তিনি একটি গ্রুপকল দিবেন তখন তুমি সবার সাথে কথা বলতে পারবে। ওখানে তোমার বন্ধুরা ও থাকবে।
রাফি খুব খুশি হল, দিনে তার জ্বর একটু কম হলে ও রাতে আবার বেড়ে গেল। ভোরের দিকে জ্বর একটু কমে আসলো। শাহিদা বেগম স্বামীকে বললেন, রাফিকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে!
রেজা বললেন, এখন জ্বর কোন ডাক্তার তাকে দেখবেননা, আমি ডা.রশিদের সাথে হাসপাতালে দেখা করেছি, তিনি প্রেসক্রিপশন দিলেন আর কি কি করতে হবে তা ও বলে দিয়েছেন। এই সময়ে শিশুদেরকে প্রফুল্ল রাখতে বলেছেন। তাই আমরা রাফিকে বেশি করে সময় দেব।
শাহিদা বেগম বললেন, আমি ও মিলি ম্যাডামের সাথে কথা বলেছি , তিনি ও সেইম বললেন আর মাঝে মাঝে রাফির সাথে কথা বলবেন বলেছেন।
রাফি যখন ফোনে বাদল স্যারের সাথে কথা বলছিল তখন সেখানে তার ক্লাসের রাইসা, আব্দুর রহিম আর মিথুন ছিল। অনেকক্ষণ ওদের সাথে কথা বলে রাফির খুব ভালো লাগলো। বাদল স্যার বললেন, এবার থেকে তোমাদের সাথে এভাবে কথা হবে, কেউ মন খারাপ করবেনা। বাড়ির বাহিরে অযথা যাবেনা, গেলে অবশ্যই মাস্ক পরবেই। মা বাবার কথা মন দিয়ে শুনবে সাথে বইগুলোতে তোখ বুলাবে। কোন কিছু জানতে হলে যোগাযোগ করবে।
এর এক সপ্তাহ পর রাফির মন পুরো ভালো হয়ে গেলো। সে প্রতিদিন সরাসরি না হলে ও ফোনে স্যার , ম্যাডাম ও বন্ধু কারো বা কারো সাথে কথা বলতে পারছে।রাফির স্কুলের টিচাররা খুব ভালো মনের মানুষ। তারা সবার আগে শিশুদের কথা ভাবেন বলেই সরকারি নির্দেশনা মেনে নিজের মত করে সকল শিক্ষার্থীদের খোঁজ নিচ্ছেন। এটাই কি কম পাওয়া ? জাতি গঠনের কারিগরদের তো এমন হতেই হবে তাইনা? আদর্শ শিক্ষক সব সময় উদার থাকেন , তাদের কাছে রাফিরা সবার আগে।
রাফি বলেই চলেছে মাকে, মা মা আমি কিন্তু ঈদে মিথুনের বাসায় বেড়াতে যাব। আমার স্যার ম্যাডামদের কিন্তু ঈদের দাওয়াত দিতে হবে । আমি মাস্ক পরে যাব করোনা কিচেছু করতে পারবেনা দেখো।
শাহিদা বেগম হেসে বললেন, আচ্ছা ঈদ আসুক বাবা তখন দেখা যাবে। পরিস্থিতি ভালো হলে আমরা সবাই বেড়াতে যাব।
রাফি মনের সুখে হাতে দিন গুনতে থাকে কতদিন বাকি ঈদের? মাকে বলে, মা নতুন জামা পরে কি হবে যদি বেড়াতে না পারি ?
শাহিদা বললেন, তোমাকে বলেছি তো আল্লাহ ধৈয্যশীলদের ভালেবাসেন। আমরা ধৈয্য ধরব ইনশাহ আল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।
রাফি মনের আনন্দে বলল, ইনশাহআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবো দেখো।
রাফি বহুদিন পরে বাবার সাথে ফ্ল্যাটের ছাদে এসেছে। কতদিন পরে খোলা আকাশ দেখল, দুচোখ ভরে সে দেখতে লাগল আকাশ । বাবাকে বলল, বাবা আকাশ কত বিশাল তাইনা?
রেজা বললেন, হ্যাঁ বাবা খুব বিশাল।
রাফি মনের আনন্দে আকাশের দিকে তাকিয়ে গাইছে , একদিন ছুটি হবে ....অনেক দূরে যাবো ... নীল আকাশের সবুজ ঘাঁসে খুশিতে হারাব!
বি. দ্র.ছবিগুলো আমার তোলা ।
shamsun
Fouzia
30/4/2021
New
York, USA .
No comments