Header Ads

বিপর্যস্ত হেফাজতে ইসলামঃ আড়িপাতা এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তা


বিপর্যস্ত হেফাজতে ইসলামঃ আড়িপাতা এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

বাংলাদেশে কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক সম্প্রতি এক ভদ্রমহিলাকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও এলাকায় অবস্থিত রয়েল রিসোর্টে উঠে একটি রুম ভাড়া নেন। স্থানীয় কিছু সাংবাদিক এবং ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পৃক্ত ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা মামুনুল হককে কয়েক ঘন্টা সেখানে অবরুদ্ধ করে তার সাথে ভদ্রমহিলার পরিচয় জানতে চান।মামুনুল হক বলেছেন যে, তার সাথে অবস্থানকারী ভদ্রমহিলা তার দ্বিতীয় স্ত্রী।দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিলেও মামুনুল হক তার নাম বলেছেন আমেনা তৈয়বা, তার প্রথম স্ত্রীর নাম।রিসোর্টের রেজিস্টারেও তিনি তার প্রথমা স্ত্রীর নাম লিখেছেন।রিসোর্টে নিলেন জান্নাত আরা ঝর্ণাকে, নাম লিখলেন আমেনা তৈয়বা।

প্রথম বউ আমেনা তৈয়বাকে মামুনুল হক ফোনে আশ্বস্ত করে বলেছেন, রিসোর্টের ভদ্রমহিলা ‘শহীদুল ভাইয়ের স্ত্রী’, তার স্ত্রী নয়।মামুনুল হকের বোনও আমেনা তৈয়বাকে একই কথা বলেছেন।ভিডিওতে ঘটনাটি প্রচারিত হওয়ায় মামুনুলের বোনও তার ভাইকে বাঁচাতে প্রথম স্ত্রী আমেনা তৈয়বাকে অনুরোধ করেছেন; বোন আমেনা তৈয়বাকে আশ্বস্ত করেছেন যে, ঝর্ণা মামুনুলের বউ নয়, কিন্তু কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতে হবে যে, ঝর্ণা যে মামুনুলের বউ তিনি তা আগে থেকেই জানেন।বউ না হওয়া সত্বেও বউ বলতে হবে, মামুনুল হকও তাই বলে যাচ্ছেন।বউ বউ খেলা নিয়ে যে সত্য-মিথ্যার জালবিস্তার তা জাস্টিফাই করতে মামুনুল হক বলেছেন, স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার জন্য, খুশি করবার জন্য প্রয়োজনে সীমিত পরিসরে সত্যকে গোপন করার অবকাশ রয়েছে।ঠিকই বলেছেন, হাদিস অনুযায়ী বউকে খুশী রাখার জন্য মিথ্যা বলার অনুমতি রয়েছে।কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাধা হয়ে দাঁড়ালো জান্নাত আরা ঝর্ণার ডাইরী।ডাইরীতে ঝর্ণা উল্লেখ করেছেন, মামুনুল হকের সাথে তার বিয়ে হয়নি, বিয়ের প্রলোভন দিয়ে মামুনুল হক সাহেব তার সাথে মিলিত হয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বান্ধবীকে নিয়ে কক্সবাজার বেড়াতে যাওয়ার পথে রাতে সড়ক দুর্ঘটনায় মামুনুল হকের মতো বিপদে পড়েছিলেন।সাথে বান্ধবী থাকায় দুর্ঘটনাস্থলে নিজেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকার হিসেবে পরিচয় দেননি, ফলে হেনস্তায় পড়তে হয়।কক্সবাজার গিয়ে মামুনুল হক সাহেবের মতো হোটেলে ভুয়া নাম লিখে দ্বিতীয়বার বিপদে পড়েন।তিনি কক্সবাজার রওনা দেয়ার আগে ওখানকার বাণিজ্যিক ব্যাংকের এক ম্যানেজারকে পরদিন তার হোটেলে গাড়ি পাঠাতে অনুরোধ করেন, পরদিন ড্রাইভার গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাকে আর খুঁজে পান না; হোটেলের রেজিস্টারে কর্মকর্তার নাম নেই।অথচ ম্যানেজার সাহেব ফোন করে নিশ্চিত হন যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা ঐ হোটেলেই আছেন, তবে ভিন্ন নামে।

বিয়ে রেজস্ট্রি না করে মামুনুল হক সাহেব শরিয়ত বিরোধী কোন কাজ করেননি; কারণ ইসলামে বিয়ে রেজস্ট্রি করার কোন বিধান নেই, এটা মনুষ্য সৃষ্ট বিধান।কবিননামা যারা চেয়েছেন তাদের জানা উচিত, বিয়ে রেজস্ট্রি হলেও কেউ কাবিননামা নিয়ে রাস্তায় বের হন না।আমরা যারা আইন মেনে বিয়ে রেজস্ট্রি করেছি তারাও কাবিনানামার খোঁজ রাখি না।তবে ধর্ম অনুযায়ী সাক্ষী থাকতে হবে।অভিভাবকের অগোচরে গোপনে বিয়ে করা সম্পর্কে মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারি বলেছেন, গোপনে বিয়ে করা বা বিয়ে গোপন রাখা ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী কঠিন অপরাধ, তা বিয়ে নয়, জেনার সামিল।দুই বছর বিয়ে গোপন রেখে মামুনুল হক কোন্ মাত্রার অপরাধ করেছেন তা আজহারি সাহেবের বক্তব্য অনুযায়ী আলমগণ নিরূপন করতে পারেন।

জান্নাত আরা ঝর্ণা এবং মামুনুল হককে নিয়ে যাবতীয় ফোনালাপ, ভিডিও ইত্যাদি বানোয়াট ও ষড়যন্ত্রমূলক বলে তার সমর্থকরা প্রচার করছেন।তবুও সবাই যা জানতে পেরেছে তা হলো, জান্নাত আরা ঝর্ণার প্রথম স্বামী হাফেজ জাফর শহীদুল মামুনুল হকের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু; ঝর্ণার সাথে তার স্বামী শহীদুলের মনোমালিন্য সৃষ্টিতে মামুনুল হক ইন্ধন যুগিয়েছেন।হাফেজ শহীদুল ঝর্ণাকে তালাক দেয়ার পর তার অসহায়ত্বের সুযোগে মামুনুল হক ঝর্ণার ঘনিষ্ঠ হন।এই অবস্থায় মামুনুল হক বেগানা নারী ঝর্ণাকে বিয়ে করে বৈধ করে নেন।কিন্তু বৈধ করার আগে বেগানা নারীর সাথে কথাবার্তা বলা, মেলামেশা করা, বিপদে-আপদে সহায়তা করার মধ্যে শরিয়তের বরখেলাপ হয়েছে কী না তা আলেম সমাজ ভালো বুঝবেন।

পাশ্চাত্য সমাজে এই সকল ঝামেলা নেই। বরিস জনসন এবং তার বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডস হচ্ছেন বৃটেনের ডাউনিং স্ট্রিটের প্রথম অবিবাহিত যুগল।বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বিয়ে না করেই বসবাস করছেন তার বান্ধবীর সাথে, সম্প্রতি তাদের একটি সন্তানও হয়েছে এবং বৃটেনবাসী নবজাতককে শুভেচ্ছাও জানিয়েছে।কেউ শিশুটিকে আমাদের মতো জারজ বলছে না, বিয়ে না করে বেগানা নারীর সাথে একই বিছানায় থাকার জন্য জনসনকে ইংল্যাণ্ডবাসী ভোট কম দেয়নি।অনেক মুসলমানও তাকে ভোট দিয়েছেন, জনসনের নেতৃত্বে দেশ পরিচালনায় মুসলমানেরা অংশ নিচ্ছেন।এমন কি দারুল হারব দেশ বৃটেনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে দলে দলে মুসলমানেরা স্থায়ী বসতি স্থাপনের জন্য ইংল্যাণ্ড পাড়ি দিচ্ছে।বিশ্বের সেরা ফুটবলার আর্জেন্টিনার দিয়েগো মেরাডোনা তার চার চারটি সন্তান হওয়ার পর সন্তানের মা'কে বিয়ে করেন।অথচ এই মেরাডোনার প্রতি এদেশের মুসলমানেরা কত উচ্চকিত।তাহলে মামুনুল হকের উপর এত ক্ষোভ কেন? মামুনুল হক তো বরিস জনসন বা মেরাডোনার চেয়ে বেশী অপরাধ করেননি।ক্ষোভের কারণ, মামুনুল হক সারা জীবন বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্কের লোকগুলোকে মাটিতে পুঁতে পাথর ছুঁড়ে মারতে চেয়েছেন।

হেফাজতে ইসলামের নেতা মাওলানা মামুনুল হকের এই ঘটনায় পক্ষ-বিপক্ষের সব মুসলিম আহত হয়েছেন।যারা তার পক্ষের লোক তাদের দৃঢ় বিশ্বাস রিসোর্টের ঘটনাটি ষড়যন্ত্র; এরা মনে করেন মামুনুল হককে এভাবে অপমান করে গোটা মুসলিম জনতাকে অপমান করা হয়েছে।অন্যদিকে যারা মামুনুল হকের বিপক্ষের তারাও মনে করেন যে, মামুনুল হকের এমন আচরণে ইসলামের মূল্যবোধের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস হ্রাস পাবে।দুই পক্ষই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব, মত প্রকাশে কেউ কারো প্রতি সামান্যতম সন্মানও দেখাচ্ছেন না।

রিসোর্টে মামুনুল হককে ঘেরাও দেয়া এবং ফোনালাপের তথ্য ফাঁস করা গর্হিত অপরাধ।কারো ব্যক্তিগত জীবনে দলবেঁধে চড়াও হওয়া আমাদের মতো পশ্চাৎপদ সমাজেই শুধু সম্ভব।ওৎপেতে কারো ব্যক্তিগত জীবনে ঢুকে হয়রানি করার অধিকার কারো থাকার কথা নয়, ব্যক্তিগত জীবনে এমনতর হস্তক্ষেপ কোন সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্যও নয়।এক্ষেত্রে মামুনুল হকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছে।আমাদের মতো অতি ঔৎসুক্য সমাজেই শুধু এমন অভব্য, অশালীন আচরণ সমর্থন করা হয়।সমাজ সমর্থন করে বলেই বহু বছর পূর্বে এক নব দম্পতিকে আশুলিয়ায় চাঁদাবাজ মাস্তানদের পিটুনিতে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে- তাদের অপরাধ বিয়ের কাবিন নিয়ে তারা ঘুরতে যায়নি।

পাশ্চাত্যে পরষ্পরের সম্মতিতে বিবাহ বহির্ভূত নারী-পুরুষের শয্যাসঙ্গী হতে আইনগত বা সামাজিক বাধা-বিপত্তি নেই।কিন্তু বিবাহ বহির্ভূত মিলনে বড় অপরাধ হচ্ছে মিথ্যে বলা।মনিকা লিউনস্কির সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের কিন্তু বিচার হয়নি, বিচারে নিরূপন করা হয়েছে ক্লিনটন কতটুকু মিথ্যে বলেছেন।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট নিক্সন ১৯৭৪ সনে ডেমোক্রেটিক পার্টি আফিসে আড়িপাতার ঘটনার জন্য পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন; তিনি অপরাধ করেছিলেন মিথ্যে বলে; তিনি বলেছিলেন যে, আড়িপাতার ব্যাপারে তিনি কিছুই জানতেন না।মামুনুল হকও মিথ্যা বলেছেন।সত্য বা মিথ্যা যারই জয় হোক না কেন, মামুনুল হকদের ডিফেণ্ড করার জন্য সমর্থক এবং ভক্তদের কখনো ঘাটতি হবে না।হেফাজতের নেতারা যেভাবে তাকে ব্যাকাপ দিচ্ছেন তাতে প্রতীয়মান হয় যে, ধর্মের চেয়ে রাজনীতি বড়।ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থন হারালেও আওয়ামী বিরোধীরা এখন বিনাশর্তে হেফাজতিদের সাহস ও সমর্থন যুগিয়ে যাচ্ছে এবং এভাবে অন্যের হাত দিয়েই হেফাজতের খেলাফত প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সবার অজান্তে নিরবেই এগুচ্ছে।খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হোক বা না হোক, মামুনুল হকের এই ঘটনায় সমাজে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে- এখন ইসলামপন্থীরা বলা শুরু করেছে যে, মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় ও দোষ গোপন রাখতে হবে এবং ব্যক্তি জীবনের স্বাধীনতা ও গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারের কথা এখন হেফাজতে ইসলামেরও শ্লোগান।

লেখক বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক

ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশনের

সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক

ahmedzeauddin0@gmail.com

 

No comments

Powered by Blogger.