Header Ads

জল _ শামসুন ফৌজিয়ার ছোট গল্প


জল

বারেক মাঝি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, মুখটা শুকনো! মেঘে ঢাকা আকাশ যে কোন সময় বৃষ্টি নামবে। গত সতের দিন ধরে অবিরাম বৃষ্টিতে মাঠঘাঠ সব জলে ভরে গেছে। বছরের এই দিনগুলো বড় কষ্টের। আষাঢ়-শ্রাবন মাস তো বর্ষার সিজন। আজ তিনদিন ধরে ঘরে কোন খাবার নেই, নৌকাটা ঘাঠে বাঁধা ছিল, এখন কোনটা ঘাঠ আর কোনটা মাঠ বুঝার উপায় নেই।বানের জল বাড়ির উঠোনে চলে এসেছে। আজ বৃষ্টি হলে ঘরের কিনারে বানের জল এসে যাবে, কাল হয়তো ঘরে ঢুকবে!
বারেক মাঝি সাত পাঁচ ভেবে ছাতা আর গামছা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে, যদি কিছু যাত্রী পাওয়া যায়। দুপুরে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামতে শুরু করল।মানুষজন ঘরে বন্দী এ সময় প্রয়োজন ছাড়া কে ই বা বাইরে বেরোয়?

সন্ধ্যা অব্দি কজন মানুষকে নদী পারাপার করে দিয়ে মুদি দোকান হতে এক কেজি চাল আর আলু নিয়ে অন্ধকারে গলা অব্দি পানি ভেঙে ঘরে ফিরল। বানের জল ঘরের চারপাশে টুইটুই করছে। ঘরে একটা মাত্র চৌকি আছে ওটার ওপর বারেক মাঝির বউ, দু মেয়ে এক ছেলে বসে আছে। সবার মুখ শুকনো, পেটে দানা পড়েনি গত তিনদিন। একটা বাছুর , দুঠো ছাগল, তিনটে মুরগি নিয়ে তার সংসার। মানুষ বাঁচাবে না গৃহপালিত পশু বাঁচাবে ?
বারেক মাঝির বউ কুলসুমা বিবি চালগুলো ফুটালেন , আলু ছোট ছোট করে কেটে নিরামিষ রান্ধলেন। তখন রাত বারোটা বেজে গেছে! ঘুম হতে ডেকে দশ বছরের ছেলে কবির, সাত বছরের মেয়ে রহিমা আর আড়াই বছরের হালিমা কে ভাত খাইয়ে দিলেন। যদিও অভাবের সংসার তবু মাঝি তার পরিবারকে খুব ভালোবাসে!
রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে অনেক দেরী হয়ে গেলো। বারেক মাঝি ওযু করে তাহাজ্জ্বুদের নামায আদায় করে জায়নামাযে বসে আল্লাহর দরবারে কাঁদতে লাগলো, “ও আল্লা গো তুমি দুনিয়াটারে ভালা কইরা দাও! বানের জলে দেশ ভাসে তার উপর করোনা , ও আল্লা তুমি আমরারে বাঁচাও! রুজি রোজগার নাই , ঘরে পোলাপান উপোস ! আল্লাগো তুমি মোরে ক্ষমা করো! এই কঠিন বিপদ হতে ফানা চাই। ঈমানের সাথে বাঁচতে দিও গো আল্লাহ আমীন।
মোনাজাত শেষ করে দেখে কুলসুমা ও জায়নামাজে সেজদায় রয়েছে, দেখে মাঝির মনটা ভরে যায়।

কুলসুমার বাবা ছিলেন আলেম মানুষ, মেয়েকে ধর্মীয় শিক্ষা দিয়েছেন। কুলসুমা ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ালেখা করে আর পড়তে পারেনি।
পরেরদিন তুমুল বৃস্টি হচ্ছিল! ঘর হতে বাইরে বেরোবার উপায় নেই। ঘুম থেকে উঠে মাঝি দেখলো ঘরের ভেতর পানি। কুলসুমা অঝোর ধারায় কাঁদছে । আড়াইবছরের ছোট মেয়ে হালিমাকে আটকে রাখা খুব সহজ কাজ না। সে পলকেই পানিতে নেমে যায়। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ তার পরে ও বানের পানি চুইয়া ঘরে ঢুকছে।রহিমা আর কবির ভয়ার্ত চোখে মুখ কাঁচুমাচু করে চৌকির উপর বসে আছে।

কাদের মাঝি একটু বিরক্ত হয়ে কুলসুমা উদ্যেশ্য করে বলল, ”কি ? মনে হয় বানের জল আর কোনদিন দেখোনি”?
নিজের মনে বিড় বিড় করতে লাগল কাউকে দুষ দিব? সব দুষ কপালের!
ঘন্টাদু’য়েক পরে বৃষ্টি একটু কমলে ছেলে কবিরকে নিয়ে মাঝি বের হয়ে যায়। যাবার বেলা সতর্ক করে দেয় যে মেয়েদের দিকে যেন কুলসুমা নজর দেয়। ভাসান পানি, যে কোন বিপদ ঘটে যেতে পারে।
বাজারের ধারে বন্ধু মোখলেসুর সাথে দেখা! মোখলেস শেষ পর্যন্ত পোটলায় কিছু চাল ও একমগ ডাল দিলো কাদেরকে। এগুলো পেয়ে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরল মাঝি, বলল, “বিপদে বন্ধুর চেনা যায়! তুই মোর আসল বন্ধুরে মুখলেইস্যা।

কবিরকে নিয়ে মাঝি কিছু শাপলা তুলল,ইউনিয়ন অফিসের সামনে লাইনে দাঁড়ালো সরকারি ত্রানের জন্য। শহিদ মেম্বার জানালো লিস্টে কাদেরের নাম নেই! কত অনুনয় বিনয় করে ও কাজ হলো না। কাদের মাঝি বলে উঠল, আমাদের চাইতে গরীব কেডা আছে? গরীবের নাম লিস্টে থাকেনা! সবই কপাল!
ছেলে কবিরকে নৌকা করে বাড়ির উঠোনে নামিয়ে দেয় কাদের।
কাদের বলল, “ ভাত খেতে মন চাইছে না, পারলে এককাপ চা দিবি”?
চলে যায় নৌকা নিয়ে ঘাঠে। গভীর রাত অব্দি শেষ পর্যন্ত চারজন যাত্রী পেলো। অন্ধকারে হারিকেনের আলোয় পথঘাঠ তেমন দেখা যায় না। ঠারে টুরে কোনমতে নৌকা চালায় মাঝি কিন্তু বুঝতে পারে নৌকার বৈঠা টানার মত শক্তি নেই শরীলে। শরীলটা খারাপ লাগছে! জ্বর আসতে পারে।
সোজা ঘরে চলে গেলো। তখন তাহাজ্জুদের সময়, বউ বাচ্ছা সব ঘুমে। সে কোন মতে নামায আদায় করল, মনে পড়ে তার বাবার কথা রোজ রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তেন আর বলতেন, ”বুঝলে কাদের আল্লাহকে নিরলে ডাকতে হয়।” আজ মনে পড়ে তার বাবার কথা যিনি দু’বছর আগে দুনিয়ার মায়া ছেড়ে চলে গেছেন। মা তো এর ও আগে দুনিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তখন মাত্র নতুন বিয়ে করে কুলসুমাকে নিয়ে সংসার শুরু করেছে কাদের। এক বন্যায় অজানা সাপের কামড়ে কাদের মাঝির মা মারা যান। দুনিয়াতে তার আপন বলতে কেউ নাই, ঐ পরিবার ই তার একমাত্র আপন।

কুলসুমা রং চা করে দিল কাদেরকে, লেবু বা আদা ঘরে এগুলো নেই। কাদের চা মুখে দিতেই হড় হড় করে বমি করে দিলো। কুলসুমা ভয়ে স্বামীর শুশ্রুযা করতে লাগলো। এই সময়ে ঘরে খাবার বলো আর দৈনন্দিন জীবনের কোন কিছুই নাই। আছে শুধু সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলার প্রয়াস।

কাদের ফজরের নামায আদায় করে দেখে কুলসুমা ভাত বেড়ে বসে আছে।
যদি লেবু আর আদা থাকত স্বাদ হতো।
মাথাটা ভনভন করছে। হাত পা যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে তার।
দু’দিন পরে কোরবানের ঈদ! এই কদিনে পানি কিছুটা কমেছে তবে উঠোন পর্যন্ত এখনো আছে। মাঠির ঘরটা যেন বৃষ্টি আর বানের জনে কখন যে গলে পড়ে যায়! কাদের মাঝির ভয় হয় যেভাবে সাপের উপদ্রব বাড়ছে! সেদিন ও ঘরে সাপ পেয়েছিল।

এই দুর্দিনে আবার ছোটবোনকে নাইওর আনতে হলো। ওঁর শ্বশুর বাড়ির লোকজন খোঁচা দিচ্ছিল এই দূর্দিনে মায়ের পেটের আপন ভাই ও কি মরে গেছে যে একবার নাইওর নিতে আসেনা?
শেষ পর্যন্ত কাদের নৌকায় করে বোনকে তিন বাচ্ছাসহ নিয়ে এসেছিল। নিজেই খাইতে পারেনা, থাকার মত জায়গা ও নেই । মানুষজন বিপদের সময় যদি এমন হারামি করে কি আর করা! সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে অসুস্থ শরীল নিয়ে বের হল নৌকা নিয়ে। লোকজন করোনার ভয়ে মুখে মাস্ক পরে তেমনি মাঝিকে ও পরতে বলে। একটা মাস্ক রোজই পরতে হয় বলে সেটা ছিঁড়ে গেছে!
বোনকে এনে কাদেরের অনেক দেনা হয়েছে মিয়ার বাড়িতে। সে ছাগল বাড়ির দুঠো গাছ বিক্রি বন্ধক দিয়ে কিছু টাকা এনেছিল আজ তা শোধ করতে হবে। আবার গন্জের দোকানে ও বাকিতে জিনিস এনেছিল। এত টাকা কোথায় পাবে?
নৌকা নিয়ে ঘাঠে যেতেই মিয়া বাড়ির ছোটমিয়ার সাথে দেখা! টাকা ধার করার পর থেকে তারা কাদেরের নৌকায় ফ্রিতে চড়ে । ছোটমিয়াকে দেখে নৌকায় তুলে অনুনয় করল যে টাকা শোধ পারবে না। ছোটমিয়া বলল,”কাদের এতগুলো টাকা কি শুধু ঐ গাছ দিয়ে শোধ হয়? সময়মত টাকা ফেরত দিতে পারলে না”।
কাদেরের বউটা কাঁদতে লাগল। ছেলে মেয়ে সবাই কাঁদছে । আগামী কাল ঈদ! ঘরে সামান্য চাল ছাড়া কোন খাবার নেই। ঈদের দিন কাদেরের ঘরে নেই কোন উৎসবের আমেজ। ঈদের জামাতে যাওয়া হয়নি, করোনার জন্য আগের নত লোকজন মসজিদে একসাথে নামাজ পড়ে না।
কাদের মুখ কাঁচুমাচু করে বলল , “ছোটমিয়া আমার ঘরে কোন খাবার নেই, আমি কেমনে টাকা শোধ করব ? বানের জল কমলে শোধ করে দেব।”
এত অনুনয় করে ও কাজ হলো না পরেরদিন মিয়ার বাড়ি হতে লোকজন এসে কাদেরের ছাগল দুঠোই নিয়ে গেলো। যাবার বেলা বলে গেলো তুমি ও আর কোন টাকা পাও না এগুলোর মূল্য । মিয়ার কাছে তোমার ধার টাকা শোধ হয়ে গেলো।
কুলসুমা চালগুলো দিয়ে পাতলা খিচুড়ি বানালো। ঈদের দিন খিচুড়ি খেতে খেতে ছেলেটি বলল, ”বাজান মিয়ার বাড়ি পশু কোরবান দিছে ! গেলে মাংস পাবো।”

কাদের মাঝির ঘরে কান্নার রোল বাড়তে লাগলো। বানের জলে চোখের জলে ঈদ একাকার।
কাদের ছেলেকে নিয়ে মিয়ার বাড়ি গেলো ! মিয়া বললেন,”কাদের তুই খুব দেরি করে এলি!”
কাদের চলে আসছিল তখন পেছন থেকে এক পোটলা হাতে দিলেন মিয়া।
বললেন, ”শুধু দিলাম তোরে কারণ তোর দুনুটা ছাগল কোরবান করেছি। আর ঐ হচ্ছে ছাগলের গোশত! ”
কাদেরের মনটা ছাৎ করে উঠলো! ঘরে ফিরে বউকে গোশতটা দিয়ে পুরো ঘঠনা খুলে বলল। বউ বলে উটলো ,”এই মাংস আমি রানমু না। এটা আমার ঘরের পালা ছাগলের মাংস।”

বলতে বলতে কেঁদে ফেলল। কাদের বলল, “কেঁদে কি করবি রে বউ! মিয়া বাড়ির মিযারা বড় বদ! আমার ছাগলের পুরো দামই তো দিলোনা! আবার ছাগলগুলো কোরবান দিলো। আল্লাহ সব দেখছেন” ।
গরীবের জন্য আল্লাহ ছাড়া সহায় কেউ নাই।
Shamsun Fouzia
New York

No comments

Powered by Blogger.