Header Ads

অপ্রতিরোধ্য ইসরাইল এবং ইরান


অপ্রতিরোধ্য  ইসরাইল এবং ইরান

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

 

সম্প্রতি ইরানের একটি পারমাণবিক কেন্দ্রে অন্তর্ঘাতমূলক হামলা হয়েছে।অন্তর্ঘাতমূলক হামলায় যে বিস্ফোরণ হয় তাতে তেহরানের দক্ষিণে নাতাঞ্জ পারমাণবিক কেন্দ্রটির কতটুকু ক্ষতি হয়েছে তা স্পষ্ট হয়নি।ঘটনার কয়েকদিন আগে এই পারমাণবিক কেন্দ্রে উন্নতমানের সেন্ট্রিফিউজ সংযোজন কার্যক্রম উদ্বোধন করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি।ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার কাজে সেন্ট্রিফিউজ ব্যবহৃত হয়, যার মাধ্যমে রিঅ্যাক্টর ফুয়েলের পাশাপাশি পারমাণবিক অস্ত্রও তৈরি করা সম্ভব।এর আগে ইসরাইলি সাইবার আক্রমনে একই পারমানবিক কেন্দ্র বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়েছিলো।গত বছরের জুলাই মাসেও নাতাঞ্জ কেন্দ্রের সেন্ট্রিফিউজ স্থাপনায় আগুন লেগেছিল এবং এই আগুন লাগাকেও অন্তর্ঘাতমূলক হামলা বলে উল্লেখ করেছিলো ইরান।ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এই সকল নাশকতামূলক ঘটনা ঘটাচ্ছে বলে ইরান মনে করছে।ইরান তাদের সুযোগ মতো যে কোন সময়ে এই সকল হামলার প্রতিশোধ নেয়ার প্রতিজ্ঞা করেছে।ইতোমধ্যে সমুদ্রপথে একটি ইসরায়েলি মালবাহী জাহাজের মূল অংশে হঠাৎ করে দুটি বিশাল গর্তের সৃষ্টি হলে  ইসরাইল তার জন্য ইরানকে দায়ী করে।তার আগে ইরানের একটি জাহাজের মূল অংশ ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় 

 

ইরানের পারমানবিক স্থাপনায় এই অন্তর্ঘাতমূলক হামলা এমন সময় ঘটলো যখন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, চীন এবং রাশিয়ার সাথে ইরানের সম্পাদিত পারমাণবিক চুক্তিটি পুনরুজ্জীবিত করার কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়েছে।২০১৫ সনে সম্পাদিত এই চুক্তি থেকে ২০১৮ সনে যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে গিয়েছিল।প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আমেরিকাকে আবার এই চুক্তিতে ফিরিয়ে আনতে চান।উল্লেখিত পারমাণবিক চুক্তি অনুযায়ী ইরান শুধু বিদ্যুৎ তৈরির জন্য সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপাদন মজুদ করতে পারবে। ইরান বারবার ঘোষণা দিয়েছে যে, তাদের পরমাণু কর্মসূচী শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা হবে; কিন্তু ইসরায়েল তা বিশ্বাস করে না।ইসরাইল মনে করে ছয় জাতির সাথে সম্পাদিত পারমানবিক চুক্তি দিয়ে ইরানকে পারমানবিক বোমা তৈরি থেকে বিরত রাখা যাবে না, ইরানকে দমানোর জন্য অর্থনৈতিক অবরোধ অধিক কর্যকর।ইসরাইলের বিশ্বাস, ইরানের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ বহাল থাকলে ইরান দুর্বল হবে; হয়েছেও তাই, অবরোধের কারণে ইরানের অর্থনীতি ইতোমধ্যে কঠিন চাপের মুখে পড়েছে।ইসরাইল মনে করছে, ছয় জাতির সাথে চুক্তি পুনরুজ্জীবিত হলে এই অবরোধ উঠে যাবে এবং ইরান অপ্রতিহত গতিতে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে।তাই ইসরাইল চুক্তিটির পুনরুজ্জীবন ভেস্তে দেয়ার অভিপ্রায়ে নাশকতামূলক হামলা চালিয়ে ইরানকে উত্তেজিত করছে

 

ইরান গোপনে পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করছে বলে ইসরায়েল নিশ্চিত।ইরানকে তারা মধ্যপ্রাচ্যের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি মনে করে।ইরানের পরমাণু কর্মসূচীকে ইসরাইল তাই ধ্বংস করার গোপন তৎপরতা চালাচ্ছে।ইসরায়েল ২০১০ সনে প্রথম কম্পিউটার ভাইরাস দিয়ে ইরানের পরমাণু কেন্দ্রের সেন্ট্রিফিউজ ব্যবস্থাকে অকেজো করে দেয়। গত বছর নভেম্বর মাসে ইরানের শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী মহসিন ফখরিজাদেহ আততায়ীর আক্রমনে নিহত হন; তিনি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচীকে সামরিক লক্ষ্যে গড়ে তোলার কার্যকলাপ পরিচালনা করছিলেন। এর আগে ইরানের কয়েকজন পরমাণু বিজ্ঞানী রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন।ইরানের নাতাঞ্জ পারমাণু কেন্দ্রের সাথে সংশ্লিষ্ট আরও  যে সকল বিজ্ঞানীকে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ গোপনে হত্যা করেছে তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন, . মাজিদ শাহরিয়ারি, মাসুদ আলী মোহাম্মদী, দারিউশ রেজায়ি, মোস্তফা আহমাদ রোশান

 

অপহরণ গুপ্তহত্যায় ইসরাইলের মোসাদ বিশ্বে অদ্বিতীয়।ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ পারে না এমন কোন কাজ নেই।ইসরাইলের স্বার্থের পরিপন্থী কর্মকাণ্ডের সাথে সংশ্লিষ্টদের গুপ্তহত্যায় মোসাদ এত পটু যে, মৃতদেহ ব্যতীত আর কোনো প্রমাণ তারা রেখে যায় না।এই সংস্থার ক্ষীপ্রতা বিশ্বের কাছে এক বিস্ময়।মোসাদের কিছু গুপ্তহত্যা কল্প কাহিনীকেও হার মানায়।মোসাদ এখনো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লুকিয়ে থাকা  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হিটলারের নাজি বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের খুঁজে খুঁজে অপহরণ করে ইসরায়েল ফেরত এনে বিচারে সোপর্দ করছে।১৯৭২ সনের মিউনিখ অলিম্পিকে ইসরাইলি খেলোয়াড়দের উপর গুলি চালানো ফিলিস্তিনিদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করে মোসাদ গোয়েন্দারা।এছাড়াও ইরাকের দূরপাল্লার কামানের গবেষক জেরাল্ড বুল, হামাসের ড্রোন প্রজেক্টের দলনেতা মোহাম্মদ জাওয়ারি, রকেট আধুনিকায়নের ফিলিস্তিনি গবেষক ফাদি আল-বাৎশ, ফিলিস্তিনের ফাতাহ আন্দোলনের উপ- প্রধান আবু জিহাদ, ফিলিস্তিনের ইসলামিক জিহাদ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ফাতহি শাকিকীসহ আবাবিল- ড্রোনের আবিস্কারক মোহাম্মদ আল-জাওয়ারিকে ইসরাইলের মোসাদ এত নিপুণভাবে হত্যা করেছে যে, হত্যার পর গবেষণার পর গবেষণা করে শুধু ধারণা করা হয়েছে, মোসাদ ছাড়া এমন গুপ্তহত্যা আর কারো পক্ষে করা সম্ভব নয়।বিস্ময়কর বিষয়টি হচ্ছে, মোসাদ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই সকল গুপ্তহত্যা পরিচালনা করেছে

 

১৯৭৯ সনে ইরানে ধর্মীয় নেতাদের ক্ষমতায় আসার পর ইরান ইসরায়েলের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে বসে; ফলে ইসরাইল তার অস্তিত্ব রক্ষায় ইরানের ঘোর বিরোধী।সিরিয়ার সিভিল ওয়ারে ইসরাইল কোন পক্ষ অবলম্বন না করলেও ইরান সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আসাদকে প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন করে যাচ্ছে, সিরিয়ার ভেতরে ইরানের সামরিক ঘাঁটিগুলোতে ইসরাইলের অপ্রতিরোধ্য বিমানবাহিনী বারবার আক্রমন করে যাচ্ছে।ইসরায়েলের পার্শ্ববর্তী দেশ লেবাননের শিয়াপন্থী মিলিশিয়া সংগঠন হিজবুল্লাহর মুসলিম যোদ্ধাদের অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত করে যাচ্ছে ইরান।ইয়েমেনে সৌদি আরবের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ইরান হুতি সম্প্রদায়কে যুদ্ধাস্ত্রসহ সর্বাত্মক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ইরানের এমন প্রত্যক্ষ পরোক্ষ উপস্থিতি ইসরাইলকে ইরান বিরোধী করে তুলেছে।মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের এই প্রভাব সৌদি আরবও সহ্য করছে না, তাই ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইলের কর্মকাণ্ডকে সৌদি আরব গোপনে সমর্থন যুগিয়ে যাচ্ছে।এমন কী ইরানের পারমানবিক স্থাপনা ধ্বংস করার জন্য সৌদি আরব ইসরাইলকে প্ররোচনা দিয়ে যাচ্ছে।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্মত থাকলে ইসরাইল বহু আগেই ইরানের পারমানবিক স্থাপনা ধ্বংস করে দিতে পারতো।ইসরাইলের দৃশ্যমান আক্রমনে ইরানের পারমানবিক স্থাপনা ধ্বংস হলে মুসলিম জগতে বিরুপ প্রতিক্রিয়া কঠোর হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় আমেরিকা সৌদি আরব ইসরাইলের কথায় কান দেয়নি

 

নাতাঞ্জ পরমাণু কেন্দ্রের স্পর্শকাতর যন্ত্রপাতি মাটির অনেক গভীরে সুরক্ষিত জায়গায় অবস্থিত।তারপরও ইসরাইল কিভাবে মাটির গভীরে গিয়ে এই বিস্ফোরণ ঘটাল তা শুধু বিস্ময় নয়, গবেষণারও বিষয়।আশ্চার্যের বিষয় হচ্ছে, ইরান এই আক্রমনের পূর্বে একটুও আন্দাজ করতে পারেনি।ইসরাইল ১৯৮০ সনে ইরাকের পারমানবিক স্থাপনাও ধ্বংস করে দিয়েছিলো, অথচ তখন ইরানের সাথে যুদ্ধাবস্থায় ইরাক সর্বোচ্চ সতর্কতার মধ্যে ছিলো।১৯৭৩ সনের যুদ্ধে মিশরকে দেয়া রাশিয়ার স্পর্শকাতর যুদ্ধাস্ত্র ইসরাইল অক্ষত অবস্থায় যুদ্ধের ময়দান থেকে তুলে নিয়ে যায়।ইরানের পারমানবিক কর্মসূচি যে ব্যাহত করা সম্ভব ইসরাইল তা বারবার প্রমাণ করে দিয়েছে।তাই সংশয় জাগে, ইরানের পারমানবিক বোমা ইরানের ভূখণ্ডে বিস্ফোরিত হবে না তো? তবে ইরান ফিনিক্স পাখি।১৯৮০ সনে যুদ্ধের শুরুতে ইরাকের সেনারা খুব দ্রুত ইরানের কয়েকশ মাইল ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলো, কয়েক দিনের মধ্যে ইরান দখলে আসবে বলে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেই ঘোষণা আট বছর যুদ্ধ করেও বাস্তবায়ন করতে পারেননি তিনি।সাদ্দামের ইরাক আর ইসরাইল কিন্তু এক নয়; ইহুদিদের মাথা সাদ্দামের মতো মোটা নয়।সাদ্দাম আর গাদ্দাফির মতো আত্মাহুতি না দিয়ে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে সর্বোচ্চ মানের কৌশলী হতে পারলে ইরান মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে অন্যতম খেলোয়াড় হিসেবে ইসরাইলের সমীহ আদায় করে নিতে পারবে

 

লেখক বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক

ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশনের

সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক

ahmedzeauddin0@gmail.com

 

No comments

Powered by Blogger.